ব্লুটুথ ও এয়ারড্রপের মত ফাইল শেয়ারিং সেবা নিষিদ্ধ করতে চায় চীন। এর মাধ্যমে তারা স্বাধীনভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর আরও কড়াকড়ি আরোপ করতে যাচ্ছে। খবর বিবিসি।
এই প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনা করতে চীনের ইন্টারনেট সেবা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার থেকে এক মাস ব্যাপী একটি গণ আলোচনা কার্যক্রম শুরু করেছে।
তারা বলছে, অবৈধ ও ‘আপত্তিকর’ তথ্য যেন ছড়িয়ে না পড়তে পারে, তা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে তারা।
অ্যাক্টিভিস্টরা আশঙ্কা করছে, এর ফলে তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।
ব্লুটুথ, এয়ারড্রপের মত ফাইল শেয়ারিং সেবা চীনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীনের তথাকথিত ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’এর কারণে, যেটি চীনের নাগরিকদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে দেশটির সরকার ব্যবহার করে, বিশ্বের অন্যতম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহার ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হয় চীনের নাগরিকদের।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক কার্যক্রমে ও মানুষকে সংগঠিত করতে এয়ারড্রপের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে চীনে। গত অক্টোবরেই তৃতীয় দফা ক্ষমতায় আসার আগে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিরোধী পোস্টার এয়ারড্রপ ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সাংহাইয়ের সাবওয়েতে।
অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে এয়ারড্রপ জনপ্রিয় কারণ এর মাধ্যমে কাছাকাছি থাকা ডিভাইসের মধ্যে ব্লুটুথ কানেকশনের ওপর নির্ভর করে তথ্য আদান প্রদান করা যায়। আর এই পদ্ধতিতে তথ্য আদান-প্রদানের ফলে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার হয় না এবং এটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্ক ব্যবহার না করে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে, ফলে এই ধরণের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি করা সম্ভব হয় না।
তবে জিনপিং তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরই অ্যাপল এয়ারড্রপের একটি নতুন ভার্সন চীনের বাজারে ছাড়ে। ঐ ভার্সনে এয়ারড্রপ ফিচারের কার্যক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়। কেউ যদি আপনার কন্টাক্ট লিস্টে না থাকে, তাহলে আইফোন ও অন্য অ্যাপল ব্যবহারকারীদের জন্য ১০ মিনিটের মধ্যে ফাইল শেয়ার বা ট্রান্সফার সম্পন্ন করতে হবে,এমন বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে।
১০ মিনিটের বেশি সময় পর শুধু কন্টাক্ট তালিকায় থাকা ব্যক্তিই ফাইল শেয়ার করতে পারবেন।
এই ফিচারটি শুধু চীনের বাজারেই কেন ছাড়া হলো, সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি অ্যাপল। অ্যাপলের বিরুদ্ধে ‘বেইজিংকে তুষ্ট করে চলার’ অভিযোগ অনেক আগে থেকেই আছে।
অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, চীনে হাতো গোনা যে কয়েকটি ফাইল শেয়ারিং মাধ্যম রয়েছে, সেগুলোর ওপরও আঘাত করা হবে সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হলো।
মঙ্গলবার চীনের ‘সাইবারস্পেস অ্যাডমিনস্টেশন’ যে প্রস্তাবনাগুলো পেশ করে, সেখানে ‘আপত্তিকর তথ্য তৈরি, কপি ও শেয়ার করা প্রতিরোধ ও প্রতিহত’ করার প্রস্তাব তোলা হয়।
এছাড়া ব্যবহারকারীরা যেন সেবা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নিজেদের আসল নাম ব্যবহার করে, সেই বাধ্যবাধকতা আরোপ করারও আবেদন করা হয়।
প্রস্তাবিত এসব বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদও শুরু হয়েছে। নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট লিন শেংলিয়াংয়ের মতে, ‘বিরোধী মতকে দমন করতে ইন্টারনেটে ছোট ছোট ফাঁকি-ঝুকিকে কাজে লাগাতে চাইছে সরকার।’
এ ধরণের আরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে বলে ধারণাও প্রকাশ করেন তিনি।
বিদেশে নির্বাসিত এক চীনা ব্যবসায়ী ও সাবেক রাজনীতিবিদের বক্তব্য দিয়ে টি-শার্ট ছাপানোর কারণে লিনকে কিছুদিনের জন্য আটক করা হয়েছিল। এরপর ছাড়া পেয়ে তিনি বিদেশ চলে যান।
চীনের টেলিফোন ও অ্যাপ ডেভেলপারদেরও এই নতুন নিয়ম মেনে চলতে হবে না হলে, অ্যাপ স্টোর থেকে তাদের পণ্য সরিয়ে দেওয়া হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এমন মন্তব্য করছিলেন।
‘উইচ্যাটের মত অন্য ডেভেলপারদেরও সেন্সরশিপের নিয়ম মানতে হবে এবং আদেশ মেনে চলতে হবে।’
সরকার বিরোধী অ্যাক্টিভিস্টরা যেসব ফিচার ব্যবহার করে থাকেন, ঠিক সেই ফিচারগুলোর ওপরই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে নতুন নিয়ম। যেমন, অচেনা কারও সঙ্গে তার অনুমতি ছাড়াই ফাইল শেয়ার করার সুযোগ এবং অনুমতি ছাড়াই আরেকটি ফোনের সঙ্গে ফোন ‘পেয়ার’ বা সংযুক্ত করার ব্যবস্থা।
চীনে অনলাইন সেন্সরগুলো নিয়মিত ভিত্তিতে ছবি, ভিডিও ফুটেজ আর কমেন্ট মুছতে থাকে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত শব্দও নিয়ন্ত্রণে রাখে।
অ্যাক্টিভিস্টরাও নিয়মিতই এসব বাধা পার করে তাদের বার্তা পাঠানোর মাধ্যম খুঁজতে থাকে।
যদিও ভার্চূয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন ব্যবহার করে কোনো না কোনোভাবে বার্তা পাঠানো ও রাজনৈতিক বিরোধী মতের প্রচার করা যাবে, অ্যাক্টিভিস্টদের ধারণা, এর ফলে বর্তমানে যে পরিমাণ মানুষের কাছে খবর ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে তা অনেকটাই সীমিত হয়ে যাবে।