আসিফুর রহমান সাগরআষাঢ় গেছে, শ্রাবণেও দেখা নেই বৃষ্টির। প্রকৃতি যেন বদলে গেছে। গরমকাল বেড়ে গেছে, বেড়েছে তাপমাত্রা। বর্ষায় নেই বৃষ্টির দেখা। আবার শীতকালের সময়কাল কমে আসছে। বর্ষায় বৃষ্টি না হয়ে শরতে ঝরছে বেশি। প্রকৃতির এই আচরণে কৃষি উত্পাদনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রকৃতির এই আচরণের জন্য প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন আবহাওয়াবিদরা। তারা বলছেন, মানুষের প্রকৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণেই এখন প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ করছে।
ভাঙাগড়ার খেলা প্রকৃতিতে অনাদিকাল ধরেই চলছে। প্রকৃতি এক নিখুঁত নিয়মে চলে। প্রকৃতির সেই সূক্ষ্ম নিয়ম পদ্ধতি বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে আধুনিক মানুষের অজস্র অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে। প্রকৃতির ভারসাম্যে অতিমাত্রার হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে। মানুষের তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বৈশ্বিক উষ্ণতার চরম বৃদ্ধি ঘটিয়ে বিশ্বের জলবায়ুকে বিপজ্জনক পরিস্থিতির ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই এমনটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতি অসহায়। তার ঋতুচক্রের মনোহর রূপ বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষের আগ্রাসি উন্নয়নের থাবায়। প্রকৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরে আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, গত ১০ বছরের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছর বৃষ্টির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে দেশে। আর ২০২২ সালে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছরের বর্ষাকালে অর্থাৎ জুলাই ও আগস্টে গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তাছাড়া, সে সময়ে কমপক্ষে ১৫ দিন দেশে কোনো না কোনো অঞ্চলে তাপপ্রবাহ ছিল। সাধারণত জুলাই মাসে গড়ে প্রায় ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও গত বছর হয়েছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার। আর আগস্টেও হয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম।
এ বছরও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। জুন মাসে বৃষ্টির পরিমাণ কম ছিল। জুলাইতেও স্বাভাবিকের তুলনায় সারা দেশেই আশঙ্কাজনকভাবে বৃষ্টির পরিমাণ কম। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনায় অর্ধেকের কম। যেমন জুলাই মাসে বরগুনায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৬০০ মিলিমিটার, সেখানে এখন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৩৩ মিলিমিটার। বরিশালে ৪১৬ মিলিমিটারের বিপরীতে বৃষ্টি হয়েছে ১২৩ মিলিমিটার। নওগাঁয় ৩২৩ মিলিমিটারের বিপরীতে বৃষ্টি হয়েছে ১১১ মিলিমিটার। গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়ার এমন আচরণের জন্য মৌসুমি বায়ুর খেয়ালি আচরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বিশ্ব জুড়ে উষ্ণায়নের কারণেই বাংলাদেশের তাপমাত্রাও বাড়ছে। সাধারণত জুন, জুলাই মাস থেকেই এ দেশে বৃষ্টি শুরু হলে ভারী বর্ষণের কারণে তাপমাত্রা কমতে থাকে। গত তিন বছর ধরে সেই বৃষ্টিপাতও কমছে। গত বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে কৃষিকাজে বিশেষ করে আমন চাষ স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম হয়েছিল। এ বছরও কৃষিক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়ার যত দিক আছে, সব কিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। সব মিলিয়ে বাড়তি তাপমাত্রা, কম বৃষ্টিপাত ও দাবদাহের ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভাঙছে। শুধু দেশেই নয়, বিশ্ব জুড়েই এটা ঘটছে। ইউরোপে এবার ১৭৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশেও আগে দুই/তিন দিন তাপপ্রবাহ দেখা যেত। এবার তো দীর্ঘ ১৬ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে দেখা গেছে। আবার দিল্লিতে যে বন্যা দেখা দিয়েছে, সেটাও গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে সতর্ক করে বলেন, আবহাওয়ার এমন আচরণ সামনে আরো মোকাবিলা করতে হতে পারে। তাই, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য স্বল্পমেয়াদি আবহাওয়া পূর্বাভাস দেওয়ার মধ্যে নিজেদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে হবে, যাতে নীতিনির্ধারণী মহল সে পূর্বাভাসকে সামনে রেখে কৃষি, স্বাস্থ্য খাতে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।