প্রায় আটবছর আগের কথা। অমনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, ক্লাসের ফলাফলেও সবসময় থাকেন ওপরের দিকে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার পাশাপাশি একটি প্রথমসারির দৈনিক পত্রিকায় প্রদায়ক হিসেবেও লিখতেন। সেইসময় থেকেই নিজের ক্যাম্পাস ছাড়াও আরও অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন অমনি, যার পুরো নাম নিশাত বিনতে রায়হান। সকলেই জানতেন, কোনোকিছুতে লক্ষ্য স্থির করলে তিনি সেটি ছোঁয়ার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা স্বভাবের। সেটি কোনো কাজ, পড়াশোনার বিষয় বা শখ, যা কিছুই হোক না কেন।
সেই অমনি এবার ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে পুলিশ ক্যাডারে চতুর্থ হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এটি ছিল তার জীবনের প্রথম বিসিএস। সবকিছু ঠিক থাকলে অল্পকিছুদিন পরই তিনি হয়ে উঠবেন একজন চৌকষ পুলিশ কর্মকর্তা। নিজের লক্ষ্যে অটুট ছিলেন বলেই সাফল্য ছুঁয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন নিশাত বিনতে রায়হান অমনি। বিতর্ক, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, লেখালেখি —এত কাজে জড়িত থাকার পরও কখনো পড়াশোনায় ছাড় দেননি। ফলে ক্লাসের সর্বোচ্চ ৩.৮৭ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে অ্যাকটিভ সিটিজেন বাংলাদেশ-এর ইয়ুথ লিডার, ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশের সদস্য, বিতর্কে ছায়া সংসদের প্রধানমন্ত্রী —এমন অনেক কাজেই তিনি যুক্ত ছিলেন। এর আগে রাজধানীর হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১০ সালে এসএসসি ও ২০১২ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। দুটোতেই সব বিষয়ে পেয়েছিলেন জিপিএ ৫। সবসময় মেধার স্বাক্ষর রাখা অমনির স্বপ্ন ছিল তিনি সরকারি কর্মকর্তা হবেন।
সাধারণত যারা সব কাজের কাজী, তাদেরই পছন্দের প্রথমে থাকে সিভিল সার্ভিস। অমনির ক্ষেত্রেও তেমনটাই ছিল। তবে এজন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর লিখিত পরীক্ষার আগে নাওয়াখাওয়া বাদ রেখে দিনরাত পড়েছেন। প্রতিটি বিষয় নোট করে যত্নের সাথে আয়ত্ত্ব করেছেন। বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার পর অমনির ফেসবুক টাইমলাইনে চোখ বুলিয়ে তা আরও নিশ্চিত হওয়া গেল। পরিচিতজনদের মধ্য থেকে একজন সেখানে লিখেছেন, 'আপনার নোট করার ধরন দেখেই মনে হয়েছিল আপনি বিসিএসের ফলাফলে ওপরের দিকে থাকবেন। আপনার ক্যাডার হওয়া প্রত্যাশিত ছিল।'
অমনির বাবা এটিএম মুসা রায়হান ছিলেন সরকারের নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর)। জেলা ও দায়রা জজ হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মা জওশন আরা বেগম গৃহিণী। ভাই সেনাকর্মকর্তা মেজর এম এস আল মুজাহিদ (অমিও)। তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলায়। অমনির বিসিএসের ফল জানার পর এলাকার মানুষও খুব খুশি। এছাড়া আত্মীয়, সহপাঠী-সহকর্মীসহ সকলেই তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। অমনি বললেন, 'বাবা বেঁচে থাকলে আমার সাফল্যে খুব খুশি হতেন, তাই এই ফল আমি তাঁকে উৎসর্গ করছি। মায়ের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই, মা সবসময় আমাকে সমর্থন যুগিয়েছেন বলেই আমি এপর্যন্ত আসতে পেরেছি।' আসলে বাবা বিচার বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় পরিবারের ভিন্ন এক আবহ ছিল, সেটিই সিভিল সার্ভিসের প্রতি উৎসাহী করেছে অমনিকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে অমনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামস ইন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর করেছেন। স্নাতকোত্তর চলাকালীন সেখানে গবেষণা সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। এরপর কিছুদিন ওয়ার্ল্ডভিশন ও অ্যাকশনএইডে চাকরি করেছেন। মাঝে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ফর পিস (সিডিপি)-তে যুক্ত হন গবেষক হিসেবে। ২০১৯ সালে ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তিনি তাতে আবেদন করেন। এরপর ধাপে ধাপে প্রায় চারবছরের দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া শেষে তাকে চূড়ান্তভাবে পুলিশ ক্যাডারের জন্য সুপারিশ করেছে সরকারি কর্মকমিশন (বিপিএসসি)।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পাঠ্যক্রমের অন্যতম একটি দিক হলো হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট, অর্থাৎ মানুষের ওপর আঘাত বা বিপদ আসতে পারে—এমন যেকোনো জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। দেশের প্রেক্ষাপটে এধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশকেই প্রথম রেসপন্ডার বা সাড়াদানকারী হিসেবে দেখা যায়। ফলে দুর্যোগ নিয়ে পড়াশোনা করা অমনি যে পুলিশি দায়িত্ব পালনেও নিজেকে ঢেলে দেবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!