ইলন মাস্কের ‘দ্য নিউ ওয়াক (ইয়র্ক নয়) টাইমস’ পোস্টটি যথেষ্ট হাস্যরসাত্মক ও সৃজনশীল ছিল, যার কারণে খুব দ্রুত সেটি ভাইরাল হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ যারা ইতিমধ্যে ‘ওক মিডিয়া’ সমর্থকদের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন, তারা উত্তর দিতে ছুটে আসেন। এটা নিয়ে অনেক মজার মজার মিম্স তৈরি হয়েছে। একজন তো আবার একধাপ এগিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন ‘জোক টাইমস’। মাস্ক আরো এগিয়ে গিয়ে আবার পোস্ট করে বলেছেন, ‘আজকাল প্রকৃত প্রেস ও প্যারোডির মধ্যে পার্থক্য বলা কঠিন।’
টেক উইজার্ড খ্যাত ইলন মাস্কের দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতি এমন বিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। এর আগেও নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে অ্যাকসেস-জনিত সমস্যা নিয়ে কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও পাঠকের সঙ্গে মাস্কের টানাটানি শুরু হয়েছিল। এরপর তিনি যেসব সাংবাদিক তাদের লেখার অবাধ স্বাধীনতা ও বেতন বাড়াতে চান, তাদের টুইটারে এসব নিয়ে সরাসরি লেখালেখি করার আহ্বান জানান। তিনি তার প্রতিপক্ষদের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, তারা সাংবাদিকদের বাক্স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছেন। এই যুদ্ধে মাস্ক একা নন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ আরো অনেকেই জোট বেঁধেছেন। শুধু বিতর্কিত ব্যক্তিত্বই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা ব্যক্তি নিউ ইয়র্ক টাইমস ও তাদের ওক মিডিয়ার প্রতি বিরক্ত। নোয়াম চমস্কি বলেছেন, এই ওক মিডিয়া ম্যাক কার্থিজমের নতুন রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে প্রমাণ ছাড়াই মানুষকে বর্ণবাদী, যৌনতাবাদী বা ট্রান্সফোবিক বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এটি ভয় ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করছে, যা ভিন্নমতকে দমিয়ে দিচ্ছে এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে নিরুত্সাহিত করছে। চমস্কি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাবেক সম্পাদক বারি ওয়েইসের মামলার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যিনি বর্ণবাদী ও ট্রান্সফোবিক হওয়ার অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওয়েইস এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করে বলেছিলেন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই নতুন জাগ্রত আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় তাকে জোরপূর্বক বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার পদত্যাগপত্রে তিনি সহকর্মীদের দুর্ব্যবহার এবং অফিসের সংকীর্ণমনা পরিবেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ওয়েইস বলেছিলেন, তিনি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, যারা তাকে মিথ্যাবাদী এবং টুইটারে ও অফিসের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অ্যাপ স্ল্যাকে ধর্মান্ধ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, টাইমস কর্তৃপক্ষ তার এই হয়রানির বিরুদ্ধে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমন ঘটনা শুধু ওয়েইসের সঙ্গেই ঘটেনি; স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় ক্ষেত্রেই একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে এবং চমস্কির সমালোচনা অন্যান্য বামপন্থি বুদ্ধিজীবীর মধ্যে অনুরণন খুঁজে পেয়েছে, যার মধ্যে স্লাভোজ জিজেকের মতো ব্যক্তিও রয়েছেন। জিজেক যুক্তি দিয়েছেন যে, ওক মিডিয়া একটি ‘নৈতিক আতঙ্কে’ নিয়োজিত, যা আমাদের বাস্তব সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে বাধা দিচ্ছে। তিনি এই নৈতিক আতঙ্ককে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, এটা আমাদের মধ্যে এমন একটা অনুভূতি তৈরি করছে যে, এই বিশ্বে ভয়ানক কিছু ঘটতে চলেছে, যেটা বন্ধ করার জন্য আমাদের অবিলম্বে কাজ করতে হবে। তিনি যুক্তি দেন যে, এই ওক মিডিয়া বর্ণবাদ, যৌনতা ও ট্রান্সফোবিয়ার মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে একটি নৈতিক আতঙ্ক তৈরি করছে। এই নৈতিক আতঙ্ক দারিদ্র্য, বৈষম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বাস্তব সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করতে আমাদের বাধা দিচ্ছে। স্লোভেনিয়ার এই সমালোচক শ্রমিক শ্রেণির মানুষের উদ্বেগ উপেক্ষা করার জন্য এই ওক মিডিয়ার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ওক মিডিয়া সাধারণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগী না করে বরং তাদের অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মাতামাতি করতে বাধ্য করছে।
‘ওক মিডিয়া’ বর্তমানে একটি জনপ্রিয় শব্দ, যা এমন বিষয়বস্তু বা কার্যক্রমকে বোঝায়, যা সামাজিক ন্যায়বিচারের সমস্যা, বৈচিত্র্য, বৈষম্য, রাজনৈতিক শুদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। এটা মূলত প্রগতিশীল মূল্যবোধের প্রচার এবং সব শ্রেণির মানুষের দাবি জোরদার করার জন্য করে। এটার লক্ষ্য হচ্ছে পদ্ধতিগত অসমতা এবং অবিচার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং কথোপকথন ও সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন ঘটানো। আক্ষরিক অর্থে ওক মিডিয়া এমন বোঝালেও বর্তমানে অনলাইন জগতে এই অর্থে ব্যবহূত হচ্ছে না। তাত্ত্বিকভাবে ওক মিডিয়া ‘ডিজিটাল ক্যামেলট’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, যেখানে যোদ্ধারা ছিলেন সাংবাদিক এবং তাদের তলোয়ার ছিল কলম, যা আরো ন্যায়সংগত বিশ্বের জন্য লড়াই করবে। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য যদি কলম চালিয়ে লড়াই না করা যায়, তাহলে কলম চালানো ব্যক্তিদের ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব নয়। বর্তমানে ওক মিডিয়ার এমন অবস্থা দেখা যাচ্ছে। অত্যন্ত জরুরি বিষয় বাদ দিয়ে সাধারণ জনগণ তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পায়তারা করছে।
নিঃসন্দেহে ওক মিডিয়া বর্তমান বিশ্বে একটি নতুন দুয়ার খুলেছে, যেখানে সবাই সবার ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে পারে। সবাই নৈতিকতার অভিভাবক হয়ে উঠেছে, কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা আপত্তিকর তা নিজেরাই নির্ধারণ করা শুরু করেছে। একজন অন্যজনের সঙ্গে একমত না হলে অনলাইন জগতে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হচ্ছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ভক্স ইত্যাদি ওয়েবসাইট পরিদর্শন করলে বোঝা যায় তারা কীভাবে তাদের ভিন্নমত প্রচারের চেষ্টা করছে। এই ওক মিডিয়ার উত্থান মূলত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমের উত্থানের মাধ্যমেই ঘটেছে। এই সোশ্যাল মিডিয়াগুলো তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক ও তাত্ক্ষণিক যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে ওক মিডিয়াকে গতিশীলতা প্রদান করেছে। আমরা সবাই জানি, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এই ওক মিডিয়ার ভালো ও খারাপ উভয় দিকই রয়েছে। একদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া তথ্য প্রচারের ধারাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক করে তুলেছে। এই মিডিয়া প্রান্তিক মানুষের দাবি উত্থানের একটা প্ল্যাটফরম দিয়েছে, এমন সব গল্প ও দৃষ্টিভঙ্গি সামনে এনেছে, যা একসময় প্রথাগত মিডিয়া দ্বারা উপেক্ষিত ছিল। ‘হ্যাশট্যাগ ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার’ কিংবা ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’র মতো হ্যাশট্যাগগুলো লাখ লাখ মানুষকে একত্রিত করেছে, জাতিগত ন্যায়বিচার ও লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ার দ্রুততার জন্য একধরনের ক্যান্সেল কালচারের জন্ম হয়েছে। জাগ্রত আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেষ্টায়, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে, যার ফলে অনেক মানুষের প্রয়োজনীয় কিন্তু অজনপ্রিয় দাবি বাতিল হয়ে যায়। এই বাতিল সংস্কৃতি শুধু সংক্ষিপ্ত কথোপকথনকে দমিয়ে রাখে না, বরং একধরনের ভীতিকর পরিবেশও গড়ে তোলে, যেখানে মানুষ নেটিজেনদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে কথা বলতে পারে না।
সোশ্যাল মিডিয়ার নিজস্ব অ্যালগরিদমের কারণে এসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জনপ্রিয় ধারণা অনেক দ্রুত প্রচারিত হয় এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিগুলো চাপা পড়ে যায়। অনেক সময় এ ধরনের অ্যালগরিদমের কারণে বিভিন্ন সহিংসতামূলক বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাসাদ তৈরি হয়ে থাকে। জাগ্রত মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপে সোশ্যাল মিডিয়া দুই প্রান্ত ধারালো তলোয়ারের মতো। এটা অসামান্য প্রভাবের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনাও তৈরি করে, আবার অসহিষ্ণুতা ও সহিংস সংস্কৃতিকে উত্সাহিত করার ঝুঁকিও বহন করে। প্রচারণার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি কাজে লাগানো এবং এর ক্ষতি এড়ানোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা ওক মিডিয়া সমর্থকদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ২০১৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্যানসেল কালচারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমাদের অতিরিক্ত জাজমেন্টাল হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। এই ‘ডিজিটাল ক্যামেলট’-এর ক্রমাগত বিকাশে এবং বিভিন্ন আন্দোলনের গতিপথ গঠনে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করা এবং সংগঠিত করা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু এটা অবশ্যই দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। তবেই সোশ্যাল মিডিয়ার পরিমণ্ডলে ন্যায় ও ন্যায়ের আদর্শ সত্যিকার অর্থে বিকাশ লাভ করতে পারবে।
লেখক: ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ডেইলি সাবাহ, তুরস্ক
ভাষান্তর- আব্দুল্লাহ আল মামুন