সম্প্রতি স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। একজন তরুণ হিসেবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বর্তমানে একবিংশ শতকের চলমান অনেক কিছুই আমার অবলোকনের সৌভাগ্য হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা উন্নয়ন বা ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই উন্নয়ন ভাবনা সন্নিহিত ছিল। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ও তত্ত্বাবধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও মানবিক মূল্যবোধের অঙ্গীকার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, বিশ্বশান্তি, পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উন্নয়ন দর্শনে যুক্ত করেছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ভাবনা এবং নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত বিশেষ বিশেষ উদ্ভাবনী উদ্যোগ। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ উন্নয়নের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করেছেন। পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং তাদের মধ্যে এর সুফল পৌঁছাতে ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারপ্রধান গ্রহণ করেছেন বিশেষ সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ও কর্মসূচি।
সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকার বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। প্রায় ১৪ হাজার ২০০ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন ও প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এতে করে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস হয়েছে। করোনাকালীন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ভ্যাকসিনেশনে বাংলাদেশ অত্যন্ত সফল হয়েছে। উন্নয়নের মূলধারায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান উন্নয়নেও নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। ডিজিটাল সেবাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার’, যার সুফল আমরা পাচ্ছি।
আমাদের গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়ও। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। এ কথা সত্য, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে সংকট তৈরি হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ও নানান কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ সমস্যা পোহাচ্ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতেও বিভিন্ন সেক্টরে প্রভাব পড়ছে, তবে সরকার তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আছে। সরকার এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভিশন ২০২১’-এর মূল ভিত্তি হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন। বর্তমানে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দৃশ্যমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য—প্রায় সবখানেই ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে জনগণের তথ্য-উপাত্ত, কাঙ্ক্ষিত সেবাপ্রাপ্তিসহ প্রাত্যহিক জীবনযাপন এবং অসংখ্য কাজ সহজ হয়েছে। বর্তমান সরকার ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারেও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিল, যা আমরা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২’ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তর করা হবে। সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি ভিত্তি—স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করছে। বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরে তরুণ প্রজন্মকে ২০৪১ সালের সৈনিক হিসেবে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত হতে হবে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। আসন্ন নির্বাচনেও এই ঘোষণা একটি অন্যতম নির্বাচনি অঙ্গীকার হিসেবেই নেবে তারা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যুবসমাজের ওপর খুবই আশাবাদী। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি করতে চান। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এখন অপেক্ষা উন্নত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ দেখার। আমরাও আশাবাদী, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে। আমরা দেখে যেতে পারব। এজন্য তারুণ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমান বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। ইউএনডিপি-এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাত্, ৪৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ কর্মক্ষম। এই তরুণেরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কান্ডারি। এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ রাখতে হবে। কিন্তু শঙ্কা জেগেছে, আদৌ আমরা তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারব কি না! কারণ, তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণেরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তি পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সামাজিক অবক্ষয়সহ প্রায় সব অপরাধের পেছনে অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে মাদক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, দেশে প্রায় কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর। অন্যদিকে মাদকাসক্তির বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ধূমপান। ধূমপান হচ্ছে মাদকের রাজ্যে প্রবেশের মূল দরজা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে, তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণনেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণদের অনেকে বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
কিশোর-তরুণদের মধ্যে এহেন বাজে অবস্থাকে আরো উসকে দিচ্ছে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো। বলা যায়, আগুনে ঘি ঢালছে! সিগারেট কোম্পানিগুলো শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে (যেখানে কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি) ধূমপানের স্থান তৈরি করে দিচ্ছে, যেখানে বসে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়ে থাকে। তরুণদের মধ্য থেকে সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব স্থানে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে আসা মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ধূমপানের আখড়া তৈরি করে ব্যবসা প্রসার করাই মূল উদ্দেশ্য সিগারেট কোম্পানির। ভয়েসের গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক কোম্পানিগুলো এসব ‘স্মোকিং জোন’ তৈরিতে অবস্থান অনুসারে রেস্টুরেন্ট মালিককে এককালীন ৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থসুবিধা দেয়। এসব জোনে তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপনসামগ্রী প্রদর্শন করা হয়।
আশঙ্কার বিষয় হলো, সিগারেট কোম্পানিগুলোর মিথ্যা প্রচারণা ও প্রলুব্ধকরণ কার্যক্রমে আশঙ্কাজনক হারে দেশে বাড়ছে ই-সিগারেট, ভেপ ও হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টসমূহের ব্যবহার। সাধারণ সিগারেটের তুলনায় কম ক্ষতিকর ও সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেটকে সামনে আনছে তারা। মূলত সাধারণ সিগারেটের চাইতে ই-সিগারেট ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকর। অধিকাংশ মানুষ (বিশেষ করে তরুণেরা) ই-সিগারেটের ক্ষতিকর দিক জানেন না। ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে দেশে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট আইন, নীতি না থাকা এবং অসচেতনতা মানুষের মধ্যে প্রাণঘাতী এসব নেশাদ্রব্যের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার অন্যতম কারণ এবং মাদকাসক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যারা বর্তমানে মাদকাসক্ত রয়েছে, তাদের রোগ নির্ণয় এবং নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে সুস্থ করা এখন বড় কাজ, নতুবা তাদের মাধ্যমে নতুন মাদকাসক্ত তৈরি হবে।
মাদক ও তামাকবিরোধী আইন আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশ থেকে তামাক নির্মূল করতে ঘোষণা দিয়েছেন। মাদকের বিরুদ্ধেও তিনি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছেন। এসব পদক্ষেপ হলো উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করার যে রসদ, সেটাকে সমুন্নত রাখা। অর্থাত্, তরুণদের সুরক্ষিত রাখা, যেদিকে তিনি সদা তত্পর।
সুতরাং, তরুণ জনগোষ্ঠীকে তামাকের দীর্ঘদিনের ভোক্তা বানাতে কোম্পানিগুলো যে অপতত্পরতা চালাচ্ছে, তা রুখতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সোনার বাংলা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন করতে হলে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শিশু-কিশোর-তরুণেরা ধূমপানের মাধ্যমে ভয়াবহ মাদকের নেশায় নীল হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াক—এটা কোনো সচেতন, বিবেকবান মানুষের কারো কাম্য হতে পারে না।
লেখক: অধ্যাপক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)