বই কেনার জন্যই মনপুরা থেকে ভোলা সদরে এসেছেন মুনতাহা। সারাদিন ফুটপাতের বইয়ের দোকান ঘুরে বেশ কিছু বই কেনার পরও বাকি থেকে যায় আরও কয়েকটি বই। উপায়ান্তর না দেখে অন্য আরেকজনের পরামর্শে পাঠশালা বুক সেন্টারে খোঁজ নেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সবগুলো বই-ই পাওয়া যায় পাঠশালাতে।
মুনতাহা বুঝতে পারেন নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বই কেনার জন্য টাকা খরচ করে ভোলায় আসার প্রয়োজন নেই। অনলাইনে অর্ডার করলে বাসায়ই পৌঁছে যাবে বই। ভোলার বাইরে থেকে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে পাঠশালা থেকে কেনা বইয়ের মূল্য পরিশোধ করা যায়। প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৬ বছরের মধ্যেই বিরাট এক বইয়ের বাজারে পরিণত হয়েছে পাঠশালা বুক সেন্টার। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, মোটিভেশনাল, পাঠ্যবই, জীবনী, ভ্রমণ কিংবা অন্য যে কোনো বই কেনার বিশ্বস্ত মাধ্যম এখন এই প্রতিষ্ঠান। ভোলা জেলায় অনলাইনে বই বিক্রির ওয়েবসাইট করে বইয়ের বাজারে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে।
প্রথম পুঁজি টাকা নয়
পাঠশালার শুরুটা ছিল বই কিনতে গিয়ে ভোলা জেলার মানুষ যে ধরনের সমস্যায় পড়ে, তার সমাধান বের করা। সাধারণত একটি বই খুঁজতে গিয়ে পাঠকরা বইয়ের দোকানের দ্বারস্থ হয়। অনেক সময় এমন হয় যে, কাঙ্ক্ষিত বইটি পাঠক খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার রাজধানী ঢাকায় নীলক্ষেত, আজিজ মার্কেট, কাঁটাবন বাংলাবাজার ছাড়া বইয়ের তেমন কোনো বাজারও নেই। এসব এলাকায় অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে বই খুঁজতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না অনেকেই। বইয়ের দোকানগুলোতে পৌঁছাতে যানজটের কবলে পড়ে মানুষের সময় অপচয় হয়। দু-একটি বই কিনতে গিয়ে দেখা যায়, সারাদিনই খরচ হয়ে যায় এর পেছনে। মূলত বই কিনতে গিয়ে মানুষের এ ধরনের সমস্যার সমাধান বের করাই ছিল পাঠশালার প্রথম পুঁজি। তাদের তৈরি অনলাইন প্লাটফর্মে বই কিনলে ভিড়, যানজট কিংবা সময় অপচয়ের মতো বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
পথ চলা শুরু
পাঠশালা বুক সেন্টার শুরু হয় ২০০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভোলা জেলার বাংলা স্কুল মোড়ে ছোট এক দোকানে স্বল্পসংখ্যক বই নিয়ে। যদিও তখন ভোলা জেলায় স্কুল বা মাদ্রাসার বই ছাড়া অন্য কোনো বই যেমন কলেজের পাঠ্যবই, গল্প, উপন্যাস, ধর্মীয় বইসহ অন্যান্য বই বিক্রির কোনো প্রচলন ছিল না।কিন্তু পাঠশালা বুক সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতার পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। তবে এর জন্য ঝড়-ঝাপটা কম পোহাতে হয়নি। ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে থেমে যাননি পাঠশালা বুক সেন্টারের চেয়ারম্যান মো. আল মাসুদ, সিইও মাহামুদুল হাসান মাহিন (বর্তমান)। তাদের লক্ষ্য ছিল দেশের সবখানে বই পৌঁছে দেওয়া এবং চাকরিজীবী না হয়ে নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার। সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থান গড়ে তোলার।
ইব্রাহিম সাহেব ও ভোলা সরকারি কলেজের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীরা
২০০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভোলা জেলায় পাঠশালা বুক সেন্টারের প্রথম দিনই বই কিনে ভোলা জেলার বিসমিল্লাহ গোল্ড হাউসের পরিচালক ইব্রাহিম সাহেব। তিনিই ছিলেন পাঠশালার প্রথম ক্রেতা, তার কেনা প্রথম বইগুলো ছিল বাংলা, ইংরেজীসহ আরও কিছু বই। তারপরেই পরিচয় হয় ভোলা সরকারি কলেজের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তারা ছিলো পাঠশালার দ্বিতীয় ক্রেতা আর তাদের কেনা বইটি ছিলো এসএম জাকির হোসেনের A Passage To The English Language বইটি।
বছরে ৬ লাখেরও বেশি
২০০৭ সালে পাঠশালার যাত্রা শুরু হলেও ২০১১ ও ১২ সাল পর্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় ভোলা জেলার এই বই বেচার প্রতিষ্ঠানটিকে। যে কোনো বই নিজেদের কাছে না থাকলেও সংগ্রহ করে দিয়ে ক্রেতাদের কাছে বিশ্বস্ততা ধরে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিল প্রতিষ্ঠানটি। ‘কঠিন সংগ্রামের সেই দিনগুলো পেরিয়ে এসেছে পাঠশালা’, বললেন মাহামুদুল হাসান মাহিন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে অনলাইনে তারা প্রথমে এফ-কমার্স শুরু করেন। শুরুর দিকে অর্ডার সংগ্রহ ও তা সময় মতো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অসঙ্গতি ছিল। এসব অসঙ্গতি এখন নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সেক্টরই সফলতার সঙ্গে সুশৃঙ্খল কাজ করে যাচ্ছে।
আর তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় বছরে প্রায় ৬ লাখেরও বেশি বই গ্রাহকরা দোকানে এসে নিয়েছে। এছাড়া তাদের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির সিইও মামাহামুদুল হাসান মাহিন বলেন, বর্তমানে পাঠশালাতে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার বই বিক্রি হয়। বইমেলা চলাকালীন এই অর্ডারের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। বেশির ভাগ অর্ডারেই একাধিক বই সংগ্রহ করেন ক্রেতারা। কারণ একটি বই সংগ্রহ করতে যে পরিমাণ সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়, পাঁচটি কিংবা ১০টির ক্ষেত্রেও একই চার্জ নেওয়া হয়। অনেক সময় একসঙ্গে দুই তিন হাজার বইয়ের অর্ডারও থাকে। কোনো কারণে ক্রেতাদের বই পছন্দ না হলে কিংবা বইয়ে কোনো ত্রুটি থাকলে বই ফেরত কিংবা বিকল্প বই দেওয়ার ব্যবস্থা করে পাঠশালা।
বইয়ের চাহিদা ছেলেদের বেশি
গল্প-উপন্যাস নয়, পাঠশালাতে মোটিভেশনাল এবং কলেজের পাঠ্য বইগুলোর কাটতি সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হিসেবে মাহিন জানান, গল্প-উপন্যাসের বইগুলো ক্রেতারা সাধারণত লাইব্রেরি কিংবা ফুটপাত থেকেই সংগ্রহ করতে পারে। এ ছাড়া ধর্মীয় গ্রন্থগুলোরও বিশাল কাটতি রয়েছে পাঠশালাতে। গল্প-উপন্যাসের মধ্যে এখনো হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের কাটতি সবচেয়ে বেশি। নতুন লেখকদের বইও আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে। বিদেশি বই বিক্রির সংখ্যাটাও কম নয়। মাহিন বলেন, পাঠশালা থেকে বই সংগ্রহকারীদের মধ্যে ছেলেরাই এগিয়ে। বইয়ের অর্ডারে নারী ও পুরুষের মধ্যে শতকরা ব্যবধান ৪০-৬০। সারা দেশ থেকেই বইয়ের অর্ডার আসে। ভোলার বাইরের অর্ডারগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাধারণত কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর সহযোগিতা নেওয়া হয়।
ভোলার মধ্যে অর্ডার অনুযায়ী বই পৌঁছে দিতে নিজস্ব সাপ্লাই সিস্টেম গড়ে তোলার কাজ করছে পাঠশালা। মাহামুদুল হাসান মাহিন বলেন, দেশের যে কোনো প্রান্তে চাহি বই পৌঁছে দিতে তারা সক্ষম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বইয়ের অর্ডার আসে। তবে, ঢাকা, চট্রগ্রাম,খুলনা, ভোলা ও সিলেট থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসে। বই হাতে পেয়েই সাধারণত ক্রেতারা এর মূল্য পরিশোধ করেন। তবে, বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের প্রবণতা বাড়ছে। পাঠশালা বুক সেন্টারের দোকানে বই বিক্রির সঙ্গে ওয়েবসাইটে বই অর্ডারের পাশাপাশি ফেসবুক পেজের মাধ্যমেও প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহ করা যায়।
বই রাশি রাশি
পাঠশালাতে বইয়ের কালেকশন দেখলে বই পাগল মানুষের চোখ কপালে উঠে যাবে। বাংলা স্কুল মোড়ে পাঠশালার বইয়ের দোকান ঘুরে দেখা যায়, বিপুল পরিমাণ বইয়ের সংগ্রহশালা। শেল্ফের তাকে, কাগজের কার্টুনে কিংবা স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখা গেছে অসংখ্য বই। গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, পাঠ্যবই, দর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি, মোটিভেশনাল, ধর্মীয় থেকে শুরু করে যাবতীয় সব বিষয়ের দেশি-বিদেশি বই আছে পাঠশালার সংগ্রহে। মাহামুদুল হাসান মাহিন জানান, তাদের দোকানে একসঙ্গে দুই-তিন লাখ বই রাখার সক্ষমতা আছে। প্রতিনিয়ত তাদের সংগ্রহে আসছে নিত্য নতুন বই। এগুলো আবার চলে যাচ্ছে ক্রেতাদের কাছে। বিদেশ থেকেও অসংখ্য বই আমদানি করা হয়। এগুলোর জন্য রয়েছে আলাদা শেল্ফ। দামী এসব বই যেন নষ্ট হয়ে না যায়, এ জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয় কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে গুদামের ভেতর আর্দ্রতা প্রতিরোধের জন্য সিলিকন দানা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছু বইয়ের তাক পলি কাগজেও মুড়িয়ে রাখা হয়। বিশ্বের নামকরা প্রায় সব লেখকের বই-ই আছে তাদের সংগ্রহে। আর কোনোটা যদি না থাকে তবে, তা সংগ্রহ করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জও নেয় পাঠশালা।
ভোগাচ্ছে পাইরেসি
ভোলা জেলায় অনলাইনে এবং দোকানে বইয়ের বাজারটি এখন একচ্ছত্রভাবেই পাঠশালার দখলে। দীর্ঘ ষোল বছরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। বই মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁছে দেওয়াই পাঠশালার লক্ষ্য। বই প্রকাশক এবং লেখকদের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলে এই প্রতিষ্ঠান। তাই বইয়ের সব ধরনের পাইরেসির বিরুদ্ধে তারা। এমনটি হলে লেখকরা তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন। শুধু নিজেদের উন্নয়ন নয়, পাঠশালা চায় যেন লেখকরাও বই লিখে উপার্জন এবং সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারেন।