সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

জলবায়ু-এডিস মশা-ডেঙ্গু ভাইরাস নেক্সাস

আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৩০

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বিগত ২২ বছরের সংখ্যাকে অতিক্রম করতে যাচ্ছে বছরের ৯ মাসেই। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পুরোদেশ আতঙ্কে দিশেহারা। সবার একটাই কথা, কেন এমন ভয়ানক পরিস্থিতি। কেন বাগে আনা যাচ্ছে না, ডেঙ্গুর এমন ভয়াল থাবাকে। এই ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে হলে অবশ্যই নজর দিতে হবে আমাদের ডেমোগ্রাফিক অবস্থান, জলবায়ু, জনসংখ্যা, আর্থসামাজিক অবস্থান, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণ, এনথ্রোপোজেনিক বা মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহ করার দৈনন্দিন জীবনযাপনের কার্যক্রম। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভেকটর বাহিত রোগের জন্য মূলত তিনটি বিষয়কে নির্দেশ করেছেন। তা হলো—

১। বাহক ও পোষকের প্রাচুর্যতা;

২। রোগ সৃষ্টিকারী এজেন্ট বা প্যাথজেনের স্থানীয়ভাবে ঘনত্ব;

৩। মানুষের আচরণ ও রোগ সহনশীলতা।

বিষয়গুলো অবশ্যই স্থানীয় ও বৈশ্বিক জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। এডিস মশার প্রাচুর্যতা জলবায়ুর সব উপাদানের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ তাপমাত্রা :অন্যান্য উন্নত প্রাণীতে যেমন থার্মোরেগুলেশনের মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং যে কোনো ঋতুতে প্রাণী তার সাবলীল জীবনযাপন করতে পারে। ক্ষুদ্র পতঙ্গ মশার শরীরে এমনটি না হওয়ার কারণে তারা পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাত্ তাদের স্বাভাবিক বংশবিস্তার ও জীবনপ্রবাহ চালানের জন্য ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রাকে একটি আইডিয়াল রেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়। ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে থ্রেস হোল্ড লেভেল ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার মেটাবলিক কার্যক্রম সফল ও দ্রুততার সঙ্গে হতে থাকে। যার ফলে তাদের মিলিত হওয়ার ফ্রিকুয়েন্সি যেমন বেড়ে যায়, তেমনি স্বাভাবিকভাবে একক মশার ডিম পাড়ার ক্লাস্টারের সংখ্যাও বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, ডিম ফুটে লার্ভা বেড় হওয়ার পারসেন্ট মানে এগ হেচ্ড হওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। এবং লার্ভা থেকে সফলভাবে পিউপাতে পরিণত হয় এবং পিউপা নিরোগ থাকে বলে সাবলীলভাবে পুনরায় এডিস মশার জন্ম নিশ্চিত হয়। এটা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট যে বৈশ্বিক উষ্ণতা, বনায়ন ধ্বংস ও দ্রুত অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও আধুনিক জীবনযাপনের জন্য ব্যবহূত এসি, ফ্রিজ প্রভৃতি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মশা বিস্তারে কতটা ভূমিকা রাখছে। তাই তো বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যেমন পৃথিবীকে জ্বরে আক্রান্ত করে ঠিক, তেমনি সেই উষ্ণতা মশার ঘনত্ব বাড়িয়ে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পৃথিবীতে বসবারত মানুষের শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে জরাগ্রস্ত করে এবং মৃত্যু ঘটায়।

এবার আসি আপেক্ষিক আর্দ্রতার প্রভাবে এডিস মশার জীবনচক্রে কী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তার কথায়।

এডিস মশার ডিম পাড়ার স্থান নির্ধারণ ও ডিম পাড়ার পর তা ফুটে লার্ভা বের হওয়ার জন্য আপেক্ষিক আর্দ্রতা অনন্য ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, এম্ব্রায়োনিক ডেসিকেশান রেজিট্যান্সের জন্য সেরোসার কিউটিকল তৈরি এবং তার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আপেক্ষিক আর্দ্রতা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। অর্থাত্ যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ আপেক্ষিক আর্দ্রতা না থাকে, তবে ডিমের ডেসিকেশন অর্থাত্ শুষ্ককরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিম তার সজীবতা হারিয়ে ফেলবে বা সঠিকভাবে ডিম ফুটে লার্ভা বের হবে না। আর লার্ভার মূল আবাসস্থল হলো জমে থাকা পানি। যার মধ্যে লার্ভা ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ইনস্টার পার করে পিউপাতে পরিণত হয়। তাই বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ ঠিক থাকলে ডিম ফুটে লার্ভা উত্পন্ন হওয়ার পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা পূর্ণাঙ্গ মশার পিউপা থেকে বের হতেও মূল ভূমিকা রাখে। অর্থাত্ পূর্ণাঙ্গ মশা যখন পিউপা থেকে বের হয় তখন বেশ কিছুক্ষণ সময় নড়াচড়াবিহীন হয়ে থাকে তার শরীরে শক্ত আবরণ তৈরি হওয়া পর্যন্ত। এই আবরণ তৈরিতে ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা মূল ভূমিকা রাখে। পূর্ণাঙ্গ মশা বের হওয়ার পর তা চলাফেরা ও উড়ার কাজে ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়।

এবার বলি পানি বা রেইন ফলের প্রভাবের কথা। এডিস মশা ডিম পাড়ার জন্য জমে থাকা পানিতে ভাসমান অবলম্বন খুবই প্রয়োজন। আর এডিস মশার জীবনচক্রের চারটি ধাপের মধ্যে তিনটি ধাপই অতিক্রান্ত হয় পানিতে। তাহলে বুঝতেই পারছেন জমানো পানি না থাকলে এত লার্ভা পিউপা কখনই সম্পন্ন হবে না। তবে হ্যাঁ পানি যেমন জীবন, তেমনি পানিই মরণ হতে পারে। কারণ অত্যধিক ভারী বর্ষণ আবার মশার ডিমের ভায়াবিলিটি নষ্ট করে দেয়। ভারী বর্ষণের পর জমানো পানি থাকলে তা আবার ডিমের হ্যাচিংয়ে সাহায্য করে।

একইভাবে সূর্যের আলোর উপস্থিতি মশার আচরণগত পরিবর্তন ঘটায় সাধারণত মেঘলা ও কম আলোর উপস্থিতি দ্রুত বংশবৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। একইভাবে বাতাসের গতিবেগ মশার ডিসপারসালে সাহায্য করে এবং ইনসেক্টিসাইড রেজিসটেন্সে ভূমিকা রাখে।

ওপরের আলোচনায় এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে জলবায়ুর প্রতিটি উপাদানের অপটিমাম মাত্রা মশার বংশ বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা রাখে এবং মশার শরীরে সব শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ব্যবহার করে রেপ্লিকেশন ঘটানো ডেঙ্গু ভাইরাসের সংখ্যা ও আক্রমণের তীব্রতা দুটোই নিয়ন্ত্রণ করে।

তাই জলবায়ু, বাহক এডিস মশা ও ডেঙ্গু ভাইরাসের রসায়ন বুঝতে পারলেই এই ভয়ানক আতঙ্ক থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। তবে এই নেক্সাস বুঝতে অবশ্যই চিকিৎসা কীটতত্ত্ব বিষয়ে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে, যা একজন মেডিক্যাল এন্টোমোলজিস্টের মূল অর্জন।

তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত বিষয়াবলির দিকে লক্ষ্য করে বলতে হয়, আমাদের দেশ যেমন অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ঠিক তেমনি ডেমোগ্রাফিক অবস্থানের কারণে বাহক ও জীবাণুর প্রাচুর্যতা নিশ্চিতকরণ সব উপাদানের সরব উপস্থিতি ও পরিপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ আমাদের এই শোচনীয় পরিণতি তৈরি করেছে। আসুন, সবাই মিলে সমন্বিতভাবে এই নেক্সাস ভেঙে চুরমার করে এডিস মশা নিধন করে ডেঙ্গুমুক্ত সজীব দেশ গড়ে তুলি।

লেখক :বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

 

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন