বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

শিশু, শিক্ষা এবং খানিক অপূর্ণতার গল্প

আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ২৩:২০

একটা প্রাইমারি স্কুলে তখন সবে জয়েন করেছি সহকারী শিক্ষক হিসেবে। আমার দায়িত্ব গণিত আর বিজ্ঞান ক্লাস নেওয়া। একদিন বিজ্ঞান ক্লাসে প্রথম শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় পড়াবার কথা ছিল। এমনিই ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা সব মিলিয়ে জনা দশেকের মতো। তার ভেতরেও একজন অনুপস্থিত। খানিক মেজাজ হারালাম। ক্লাসের কয়েকজন জানালো, আজিম নামের যে ছেলেটা অনুপস্থিত সে প্রায়ই এভাবে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কাজ করতে যায়। ইটভাঁটার কাজ। ভাবলাম, ছোট মানুষ। দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকার লোভ সংবরণ করাটা আসলে কঠিন। পরদিন যখন ছেলেটাকে ক্লাসে উপস্থিত পেলাম, বেশ খানিকটা জেরা করলাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এভাবে কাজে যাবার কারণে সে লজ্জিত। প্রথম প্রথম মুখ না খুললেও খানিক পরে সে বলেই ফেললো, ইট ভাঁটায় মাঝেমধ্যেই কাজে হাত লাগায় সে। ৪-৫ ঘণ্টার মতো শ্রম দিতে হয়। ৯০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি। মাঝে মাঝে দিন মজুরের কাজও করে। টাকার পরিমাণ এরকমই। কিছু কম আর বেশি।

লেখার শুরুতেই এই ঘটনা বলার কারণ হচ্ছে, একটা গল্প বা ছবি হাজারটা পরিসংখ্যানের চেয়েও কখনও কখনও বেশি কিছু জানান দেয়। শিক্ষার এই খাতে এগিয়ে যাবার অনেক গল্পই থাকতে পারে। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দেওয়ালে কান পাতলে এখনও দারিদ্র্য আর অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করার গল্প শোনা যায়, অভাবের তাড়নায় ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। সেই কান্নার আওয়াজ সামলে এই শিশুরা স্কুলের আঙিনায় কতখানি স্বতঃস্ফূর্ত থাকবে তা আসলে সবার সামনে একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়।

মাত্র আট মাসের শিক্ষক জীবন। প্রায় অজপাড়াগাঁয়ের একখানি স্কুল। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ নিম্নবিত্ত। দিন মজুরি, কৃষিকাজ বা ছোটখাটো মুদি দোকানির ব্যবসা তাদের জীবন ধারণের উপায়। এ মানুষগুলোর সন্তানরাই আমার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী। আট মাস পরও আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীর কাছে পুরনো হইনি। এখনও স্কুলে ঢোকার সময় শিশু শ্রেণির ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ‘নয়া স্যার, নয়া স্যার’ বলে সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে। দৌড় দিয়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। ক্লাস ফোর-ফাইভের কেউ কেউ এখনও আমাকে স্যার বলার সঙ্গে সঙ্গে ‘তুমি’ বলেও সম্বোধন করে। শুধু আমাকে না, আমার সিনিয়র শিক্ষকরাও শিশুদের থেকে এই ‘তুমি’ সম্বোধন পেয়ে থাকেন। স্কুল শেষে ঘরে ফিরেই যাদেরকে অভাবের মুখদর্শন করতে হয়, তাদের কাছে শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারগুলোকে ‘বড়লোকের কারবার’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এদেরকে নিয়েই প্রাথমিক শিক্ষক আর শিক্ষা ব্যবস্থার এগিয়ে যাবার গল্প। কিন্তু আজ আমি বলতে চাই গল্পের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পর্দার আড়ালের গল্প। নির্দ্বিধায় বলতে চাই শিক্ষক হিসেবে নিজেদের ব্যর্থতার গল্পটুকুও।
আমি স্কুলে আসার পর আবিষ্কার করলাম, প্রায় বছর চারেক ধরে ধুলোবালির ভেতর পড়ে আছে স্কুলের প্রজেক্টর, জায়ান্ট স্ক্রিন আর সাউন্ড বক্সের মতো জিনিসগুলো। যেগুলো পাঠানো হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে। স্কুলের ল্যাপটপটাও দীর্ঘ দিন পড়ে থেকে অচল! তবুও ধুলোবালি মুছে সবকিছু বের করলাম। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সহায়তায় নিজের ল্যাপটপটা ব্যবহার করেই ছোটখাটো একটা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম বানাবার চেষ্টা করলাম। প্রথম দিনগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর সে কি আনন্দ! বড় পর্দায় তারা কোনোদিন স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ শেখেনি; কোনোদিন তাদের ‘মিনা কার্টুন’ দেখা হয়ে ওঠেনি। এইসব ব্যাপার-স্যাপার স্কুলে শুধু ছাত্র-ছাত্রীদেরই টানলো না, অনেক বাচ্চার বাবা-মাও স্কুলে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাস’ দেখতে চলে এলো। আমার মনটা কেমন একটা আনন্দে পরিপূর্ণ হল। স্কুলে বোধহয় নতুন দিন আসবে এবার। কিন্তু কয়দিন যেতেই ভুল ভাঙলো। পড়াশুনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে বাচ্চাদের আমি মিনা কার্টুন বা অন্যান্য শিক্ষামূলক কন্টেন্ট দেখিয়ে থাকি। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হল, অজপাড়া এই গাঁয়ে পৌঁছে গেছে ডিশ লাইন। বাচ্চারা বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভারতীয় সিরিয়াল দেখে অভ্যস্ত। সেই সঙ্গে তাদের মন-জগতের অনেকটা দখল করে নিয়েছে হিন্দি ভাষার কার্টুন মোটু-পাতলু কিংবা শিবা-রুদ্রা। যে বাচ্চাগুলো এখন পর্যন্ত ঠিকভাবে স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ পড়তে শেখেনি তারা হিন্দি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে! তাই বড় পর্দায় স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ শেখার চাইতে তাদের বেশি আগ্রহ হিন্দি ভাষার কার্টুন দেখার প্রতি।  
 
জানি না কীভাবে এসব কিছু থেকে বের হতে হবে! তবে ওদের দোষ দিয়ে আসলে খুব একটা লাভও নেই। চাকুরির এই কয়দিনে আমি একজন অভিভাবককেও দেখিনি স্কুলে এসে তার বাচ্চার পড়ালেখার খোঁজখবর নিতে বা পড়ালেখার মান নিয়ে শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ জানাতে। কিন্তু উপবৃত্তির ৯০০ টাকা পেতে দুটো দিন দেরি হলে অভিভাবকদের একটা হই-হট্টগোল বেঁধে যায় স্কুলের অফিস কক্ষে। তখন মনে হয়, পড়ালেখা করানো নয়; শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছাত্র-ছাত্রীর উপবৃত্তির টাকা ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়া। তা না পারলে শিক্ষকদের পকেট থেকে সেই টাকা পরিশোধ করা।

এতকিছুর মাঝেও ওরা চেষ্টা করে স্কুল ড্রেস পরে সেজেগুজে স্কুলে আসতে। তবে সেখানেও রয়ে গেছে অভাবের চিহ্ন। একদিন খেয়াল করলাম, ক্লাস টু-এর এক ছাত্র দড়ি দিয়ে কোনো রকমে কোমরের সঙ্গে প্যান্টটা বেঁধে নিয়ে এসেছে। প্যান্টের হুক আর জিপার দুটোই নষ্ট। 

জানা গেল, অনেক টাকা ধার করে বাবা বিদেশ গেছে। সংসারের অবস্থা একেবারেই নাজেহাল। প্যান্ট তার এই একটাই। নতুন প্যান্ট কেনা দূরে থাক, পরনের প্যান্টটা ঠিক করবার মতো আর্থিক সংগতিও এই শিশুর পরিবারের জন্য দুরুহ ব্যাপার। সেদিন পকেট থেকে ৫০টা টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোনো রকমে শিক্ষকের দায় সেরেছিলাম। কিন্তু এ দায় কি আসলেই সারবার?

উত্তর হল, না। তবে এই না-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেক গল্প। দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের মতো এ যেন এক হাত-পা বাঁধা অসহায় জীবনচক্র। সহজ করে বললে আমাদের শিক্ষকদের জীবনচক্র।
 
এই জীবনচক্র ব্যাখ্যা করতে গেলে আপনাকে দেখতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর শিক্ষাখাতের চালচিত্র। অনেক সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের রোল মডেল হলেও কিছু কিছু সূচকে দেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরেও তলানিতে। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক বাংলাদেশ সরকারের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, যেখানে তার মাসিক বেতন সর্বসাকূল্যে ১৯ হাজার টাকারও কম। জাতি গড়বার কারিগরদের এই অবমূল্যায়ন হয়তো জাগিয়েছে শিক্ষাদানের প্রতি অনিহা। আমি এমন একজন শিক্ষককে চিনি, যিনি প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ ট্রেনে করে এসে কর্মস্থলে পৌঁছান এবং দুপুর দেড়টার ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যান। যে চক্রের মূল উপাদান অবহেলা, অবহেলা আর অবহেলা, সেখানে দিন বদলের ছোঁয়া কতটা আসবে তা সহজেই অনুমেয়। প্রাথমিক শিক্ষা খাতে কেউ যেমন নির্দোষ নয়, তেমনি এককভাবেও কেউ দোষী নয়। আর এসবের মাঝে পড়ে হারাতে বসেছে কোমলমতি শিশুগুলোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের গল্প।
ওদিকে করোনায় গ্রামের শিশুগুলোর পড়ালেখার যে ক্ষতিটুকু হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে বোধ করি এক জনমও যথেষ্ট সময় নয়। ঝরে পড়বার সংখ্যাটা না হয় নাই বা বললাম। ক্লাস থ্রি পড়ুয়া অনেক ছাত্র নিজের নামটুকু শুদ্ধভাবে লিখতে জানে না। ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া ছাত্রগুলোর কাছে এখনও তাদের বইয়ের অনেক বাংলা শব্দের উচ্চারণ অজানা বা দুর্বোধ্য। স্কুলে ইংরেজি রিডিং পড়তে পারে এমন ছাত্র বা ছাত্রী আমি একজনও খুঁজে পাইনি!

এতসব বিস্ময়ের মাঝে আরও যে ব্যাপারটিতে বিস্মিত হয়েছি তা হল অনেক অভিভাবক স্কুলে তার ছেলে বা মেয়েটির নাম দিয়ে রেখেছে শুধু উপবৃত্তির টাকাটা পাবার জন্য। স্কুলের রেজিস্টার খাতায় নাম দিয়ে তারা সন্তানদেরকে পড়াচ্ছে মাদ্রাসায়। ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু গ্রামের মানুষজন কি অনেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে? আমি জানি না। এমনও হয়েছে স্কুলে ভালো পড়ালেখা করা ছেলেটা হঠাৎই স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি বাবা-মা সন্তানকে দুটো শিক্ষা না দিয়ে শুধু মাদ্রাসা শিক্ষাটাকেই বেছে নিয়েছে। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনাও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।
 
এসব কিছুর মাঝেই কাটছে দিন, পার হচ্ছে আমার শিক্ষক জীবনের সময়গুলো। জানি না, হয়তো আমিও একটা গৎবাঁধা সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছি। সেই সিস্টেমের ওপরটাই শুধু চোখে পড়ে, কিন্তু মাঝে লুকিয়ে থাকার ছবিগুলো খুব একটা সামনে আসে না। ধূসরই থেকে যায় বরাবরের মতো। শিক্ষকতা জীবনেও দীর্ঘদিনের লেখালেখির ভূতটা মাথা থেকে নামাতে পারিনি। তাই আরেকবার কলম ধরলাম আমার স্কুলের অসহায়, দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীগুলোর জন্য। হয়তো এ লেখার টাইটেলটাও কখনও কোনো উচ্চপদস্থের চোখে পড়বে না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে চাই, আমার ছাত্র-ছাত্রীগুলো এ বাঁধা টপকাবে। ওরা সেখানেই থামবে যেখানে স্বপ্ন দেখার কোনো শেষ নেই!

ইত্তেফাক/পিও