মাত্র কয়েকদিন আগে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছিলো পুরো ঢাকা। নগর কর্তৃপক্ষের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের যত্রতত্র ময়লা ফেলার অভ্যাসও এজন্য দায়ী। এতে করে নগরীর বেশিরভাগ ড্রেন এবং পর্যায়ক্রমে খালগুলো কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে, আর তাতে স্তরে স্তরে জমে থাকা ময়লার স্তূপ বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে বাধা দিচ্ছে। ফলাফল, চরম জনদুর্ভোগ।
বিষয়টি ভাবিয়েছে একদল তরুণকে। এই শহরে তিলে তিলে নষ্ট হয়ে যাওয়া খালগুলোকে রক্ষায় সচেতন হওয়ার বার্তা দিয়েছেন তারা। তারা দেখাতে চেয়েছেন, শহর পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব কেবল নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে না, বরং সবার অল্প একটু সদিচ্ছা থাকলেই চারপাশের পরিবেশকে সুন্দর রাখা যায়।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে জলাশয় রক্ষায় ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়। জলাশয় বা জলাধারের প্রয়োজনীয়তা বহুমুখী। প্রথমত, প্রাকৃতিকভাবে পানি নিষ্কাশনে কাজে লাগা। দ্বিতীয়ত, জরুরি পরিস্থিতিতে বা অগ্নিদুর্ঘটনার সময় আগুন নেভাবার জল সংগ্রহ। তৃতীয়ত, বহু দেশেই খাল বা লেকে ওয়াটার ট্যাক্সির মতো গণপরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে, যা মানুষের যাতায়াতে সড়কের ওপর চাপ কমায়। প্রকৃতিপ্রদত্তভাবে আমাদের রাজধানীতেও সেই সুযোগ ছিল। ধানমণ্ডি লেকও এককালে হাতিরঝিলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে জলকেন্দ্রিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ার মাধ্যমে মানুষের জীবন হতে পারতো অনেক সহজ ও সাচ্ছন্দ্যের। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়নে জলাশয় নির্বিচারে দখল-ভরাট হয়েছে, বিভিন্ন প্রান্তের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অধিকাংশ লেকই ডোবায় পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অবশিষ্ট থাকা খালের পানিতে ময়লা ফেলার অভ্যাস।
গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশুর নেতৃত্বে শ' খানেক তরুণের একটি দল ঢাকার মোহাম্মদপুর সোসাইটি লিমিটেড এলাকার একটি খাল থেকে নানারকম ময়লা সরিয়েছে। এতে পাল্টে গেছে ময়লায় ঠাসা খালটির পরিচিত রূপ। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও তাদের সঙ্গে এই কাজে যোগ দেন৷ এছাড়া এশিয়ান পেইন্টস ও অ্যাওয়ারনেস থ্রি সিক্সটি এতে সহযোগিতা করে৷ দুইদিনব্যাপী এই ব্যতিক্রমী কর্মসূচিতে খাল এলাকার ১ থেকে ৪ নম্বর ব্রিজের পুরো অংশ পরিষ্কার করা হয়।
কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশু বলেন, 'মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহর ডোবার পর ফেসবুকে একটা ভিডিও নজরে এসেছিল। সেই ভিডিও দেখেই মনে হলো, আমরা নিজেরাও তো খাল পরিষ্কার করতে পারি! এই কাজে কারা যুক্ত হতে চায়, জানতে চেয়ে পোস্ট করলে একশো তরুণ এতে যুক্ত হন।'
সমমনা তরুণদের সমর্থন পেয়ে মিশুর উৎসাহ আরও বাড়ে৷ এরপর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, পরে স্থানীয় পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। খাল থেকে বাসার বিছানায় ব্যবহার করা পুরনো তোষক, নষ্ট ফ্রিজ, বাথরুমের ভাঙা কমোড, প্লাস্টিকের সরঞ্জাম, বোতল, বিভিন্নরকম প্যাকেটসহ নিত্যব্যবহার্য অনেক জিনিস পাওয়া যায়। এসব আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। ব্রিজের নিচের অংশে পাইপের মুখের ময়লা সরাতে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ডুবুরি আনা হয়। সবমিলিয়ে মাত্র ৮৬,৫৩০ টাকা খরচ করে পুরো খালের চেহারাই বদলে গেছে। ব্রিজের ওপরে ও রেলিংয়েও রঙ করে দিয়েছেন তরুণরা।
দীর্ঘদিন ধরে যে খালটি ময়লার ভাগাড় ছিল, মাত্র দু'দিনের মাথায় বদলে গেছে সেই খালের চেহারা। তবে, যেহেতু খালটি হাজারীবাগ থেকে শুরু হয়ে মোহম্মদপুরের ভেতর হয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে বের হয়ে গেছে, তাই এই খালের আংশিক এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অন্যান্য এলাকা থেকে আবারও ময়লা এসে জমতে শুরু করেছে।
উন্নত দেশগুলোতে যত্রতত্র জিনিস ফেলা যায় না। এরজন্য বাড়তি টাকা গুনে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বা রিসাইক্লিং সার্ভিস নিতে হয়। ময়লার প্রকারভেদ অনুযায়ী আলাদা-আলাদা ডাস্টবিন ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক-জাতীয় কিছু আবর্জনা গলিয়ে পুনর্ব্যবহার করা হয়, কিছু আবর্জনা থেকে তৈরি হয় জ্বালানি। আলাদা ব্যবস্থাপনা দূরে থাক, আমরা এখনো সাধারণ ডাস্টবিনের ব্যবহারই ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে উঠতে পারিনি। ফলে মূল্যবান জলাশয়কেই বানিয়ে ফেলছি ময়লা ফেলার ভাগাড়।
স্থানীয় কাউন্সিলর আসিফ ও কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশু বললেন, আসলে সব মানুষকে সচেতন হতে হবে। তা না হলে এমন সমস্যা থেকে উত্তরণ নেই। বৃষ্টি হলেই শহর তলিয়ে যাবে। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশনের পক্ষে সব আবর্জনা পরিষ্কার করা অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা।
তারা বলেন, আমাদের চিন্তাভাবনা ও আচার-আচরণের পরিবর্তন দরকার। ফেলনা জিনিস সংগ্রহ ও পুনপ্রক্রিয়াজাত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে, যেন মানুষ তা যেখানেসেখানে ফেলে না দেয়৷ পাশাপাশি, আমরাও যেন কিছু একটা খেয়ে তার খোসা রাস্তায় না ফেলি। নিয়মিত পরিষ্কার অভিযান চালানোর পাশাপাশি মানুষের মাঝে সচেতনতামূলক প্রচারের মাধ্যমে পরিবর্তন আসবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত।
মোর্শেদ মিশুর মতো তরুণরা নাহয় উদ্যোগী হলেন। হয়তো তাদের দেখাদেখি এগিয়ে আসবেন আরও অনেকে। কিন্তু দিনশেষে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার দায়িত্ব তো সবার। মিশুদের উদ্যোগে সমর্থন জানিয়ে আসুন ময়লা ফেলার ব্যাপারে একটু সচেতন হই।