আইএমএফের পরামর্শে ১৯৮৯ সাল থেকে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে শেষ পর্যন্ত তা আর ধরে রাখতে পারেনি। আইএমএফ অনেক বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। দেশে এখন ডলারের সংকট চলছে। এই সময়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা চলতি বর্তমান নভেম্বরে এই কিস্তি পাওয়ার কথা। তবে তা নির্ভর করছে ঋণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শর্ত পরিপালনের ওপর। তাই সরকারি বিভাগগুলো শর্ত পূরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই সব বিষয় নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। আর্থিক খাতের স্থায়িত্ব, ব্যাংক খাতের সংস্কার, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ডলারের বাজারভিত্তিক লেনদেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি, সুদের হার ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার নামিয়ে আনতে একটি ‘সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা’ চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। তবে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ‘সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন’ পাশ হওয়ায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বরাবরই খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর (এমওইউ) করার পরামর্শ দিয়েছে এই দাতা সংস্থা।
এরই অংশ হিসেবে প্রথম দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসে সংস্থাটির রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে বিশেষ প্রতিনিধিদল। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইএমএফের ঋণের যেসব শর্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পূরণ করার কথা, তার মধ্যে বেশির ভাগ পূরণ হয়েছে। তবে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছিল, সেই পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রাখা, সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার রাখতে হবে। এখন রিজার্ভের তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন—মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ। দুই ধরনের হিসাব (মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করলেও প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। তবে প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য নিয়মিত আইএমএফকে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বলছে, জুনে দেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ (ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) অনুযায়ী জুনে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার আর বিপিএম ৬ অনুযায়ী আছে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। এর বাইরেও প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি তথ্য আছে, যা প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলারের মতো, যা আইএমএফকে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রকৃত এই রিজার্ভ দিয়ে এখন তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃতপশিল ঋণের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃতপশিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ দশমিক ১১ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকে আছে আরো প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশের হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পুনঃতপশিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে। এ শর্তও আপাতত পূরণ হচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে।
আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড় নিয়ে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছে। আগামী ১৩ ডিসেম্বরে, ২০২৩ আইএমএফের পর্ষদসভায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন পাবে। ঋণের জন্য আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পূরণ হয়েছে। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণ হয়নি। এর পেছনে দেশীয় ও বৈশ্বিক যেসব কারণ আছে, সেগুলো আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এর পরই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য বলা যায়, বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থতা, অন্যান্য সীমাবদ্ধতা, ত্রুটিবিচ্যুতিগুলোর নেপথ্য কারণ সম্পর্কে তাদের বোঝানোর চেষ্টায় সফল হয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফ পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকটা ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন কম। তবে আশা করা যায়, স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে। মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির সমপরিমাণও থাকবে এই রিজার্ভ। তবে সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের সামনে আছে উচ্চমাত্রার অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি। তারা বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশকে একদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, অন্যদিকে দক্ষতা আনতে হবে খরচ করার ক্ষেত্রে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে চাপ পড়েছে সাধারণ জনগণের ওপর, তা মোকাবিলায় অধিকতর মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশকে। শুধু তাই নয়, ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করাও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো, পুরো ব্যাংক খাতে তদারকব্যবস্থা বৃদ্ধি ও সুশাসন জোরদার করলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়নও জরুরি।
আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত প্রতিনিধিদলের কাছে ঋণের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়ানোর কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেছে এনবিআর। তবে আইএমএফের কর্মকর্তারা উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে এনবিআরকে আরো তত্পর হওয়ার সুপারিশ করেছেন। ঋণ কর্মসূচির আওতায় আইএমএফের অন্যতম শর্ত হচ্ছে চলতি অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। এই শর্ত পূরণে এনবিআরকে চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। এক বছরের ব্যবধানে এত বড় প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে, তার কর্মপরিকল্পনা এনবিআরের সদস্যরাা পৃথক তিনটি বৈঠকে ঢাকায় সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সামনে তুলে ধরেছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে কর অব্যাহতি কমানো, আমদানি পর্যায়ের শুল্কহার ধীরে ধীরে কমানো এবং করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ ছিল আইএমএফের। কিন্তু এগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমসের অটোমেশনে ধীরগতি নিয়ে মিশন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সর্বশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়েছে, যা রিজার্ভ কমিয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। একই সময়ে একাধিক বিনিময় হার, সুদের হারের সীমা ঠিক করে দেওয়া, ব্যাংক খাতে অপর্যাপ্ত তদারকি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির চেয়ে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে, যা এ দেশের বহু পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়েছে। নানা অনিশ্চয়তায় বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। এ ছাড়া জ্বালানির উচ্চমূল্য, কাঁচামালের বাড়তি দাম এবং গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের অভাবে শিল্পোত্পাদন কমেছে। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু স্বল্পমেয়াদি সংস্কার লাগবে। যেমন—নমনীয় বিনিময় হার প্রবাসী শ্রমিকদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোয় সহায়তা করবে, আবার প্রবাসী আয়ও বাড়বে। এছাড়া সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া এবং মুদ্রানীতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। একই সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাতের সংস্কারে ব্যাংক খাতে শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত একক পণ্যের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল। তাই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। কারণ, রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধির নতুন নতুন চালিকাশক্তি লাগবে। দ্বিতীয়ত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনে কার্যকর বিনিয়োগ আনতে হবে। এজন্য আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শেয়ারবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের উত্স হিসেবে পরিণত করা উচিত। তৃতীয়ত, যানজট ও পরিবেশের দুর্বল পরিস্থিতির কারণে নগরায়ণের সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া অবকাঠামো দুর্বলতা ও মানবসম্পদ নিম্নমানের কারণে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া কর্মসংস্থান তৈরি, লিঙ্গবৈষম্য কমানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা—এসব বিষয়ে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চাপে পড়লেও আমরা বেশ আশাবাদী। কারণ, এ দেশের অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। যেমন—জনসংখ্যা বোনাস, তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি, বিশাল প্রবাসী গোষ্ঠী ইত্যাদি। সময়মতো সঠিক নীতি সংস্কার করতে পারলে আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ, ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা