মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সন্দ্বীপের সবুজ হাতছানি

আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ২৩:০০

শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। সমুদ্র তীরবর্তী মানুষের সংগ্রাম শুধু দারিদ্রের সঙ্গে নয় প্রকৃতির সঙ্গেও। এখানে প্রকৃতির সংগ্রাম কতটা রুঢ় ও কতটা বাস্তবিক তা আমরা শুধু আন্দাজ করতে পারি। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কথাই মনে করে দেখুন। সেই অঞ্চলকে জানার আগ্রহ অনেকের থাকতে পারে। জীবনকে জানার মানে, সবকিছুকে দেখা। তারজন্য সংগ্রামে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করতে হবে এমন ভাবনায় গলদ রয়েছে বৈকি! প্রথমেই দুর্যোগের কথা বলে আপনাকে দমিয়ে দেওয়া উদ্দেশয় নয়। বরং আপনার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা। দেখবেন নাকি এই প্রকৃতিকে?

যে প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় সে কেমন শান্ত-সৌম্য-স্নিগ্ধ! রুদ্রপ্রতাপ তো সুন্দরেরই থাকে। প্রেয়সী যেমন সৌন্দর্যের কেন্দ্র হয়ে থাকে আপনার মনে, তেমনি তার ক্ষোভ-রাগ ও অভিমানও তো আছে। এমনই এক স্থান সন্দ্বীপ। আসছে শীতে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এক অবিস্মরণীয় ভ্রমণ সেরে আসতে পারেন এখানে। সেজন্য আপনাকে চট্টগ্রাম পৌঁছুতে হবে। সে আপনি ট্রেন, বাস, জাহাজ যা দিয়েই যেতে পারেন। আপনার গন্তব্য কুমিরা নৌ-টার্মিনাল ঘাট। যেভাবেই যাতায়াত করুন, খেয়াল রাখবেন - আপনার যাত্রা যেন ভোরেই শেষ হয়।

ভোরে কুমিরা ঘাট যাত্রা শেষ করার বিশেষ কারণ রয়েছে। এখানে ভোর ৭টার আগে কোনো ট্রলার স্পিডবোট পাওয়া যাবে না। আর যদি আগে পৌঁছে যান, তাহলে অনেকক্ষণ বিরক্তিকর সময় কাটানোর প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। অথবা সাগরের কোলঘেষে হেঁটে বেড়ান। ভোরের আলোয় হাটতে পারলে মন্দ কি। স্পিডবোটে চড়ার সময় যে ঘাটে দাঁড়াবেন সেটি বেশ সুন্দর। একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, বড় বড় জাহাজ স্ক্র্যাপ করার জন্য এই ঘাটে নোঙর করা হয়। সোজা হেটে দেখুন। মনে হবে সাগরের বুকে ক্রমে হেটে চলেছেন। বাহ! শুরুটাই কেমন বৈচিত্র্যময়। 

যেসব দিনে কুয়াশা খানিকটা বেশিই থাকে, সেসব দিনে বোট একটু দেরিতেই ছাড়ে। তখন আপনার বিরক্তি লাগতেই পারে। বোটে চড়ার জন্য টিকিট কাটতে হয়। তার সিরিয়াল মেনে আগানোটাও বেজায় কঠিন। তবে চারদিকে নিয়মের ছন্দের কথা ভেবে দেখুন। বোটে ওঠার পরও নিয়মের ছন্দ। বোটের ছেঁড়া, নোংরা লাইফ জ্যাকেট চেপে বসতে হবে। মোটে ২০ মিনিটের যাত্রা। পৌঁছে যাবেন সন্দ্বীপ নৌ-টার্মিনাল ঘাটে। এখানে পা দিলেই কেমন ভালো লাগবে। আশপাশে গোট্টাছড়া ঘাট ও সাগরপাড়ের ম্যানগ্রোভ আপনায় হাতছানি দেবে। হাতছানির ডাক পেয়ে এগোতে হবে ম্যানগ্রোভের ভেতরের দিকে। কালাপানিয়া পৌছাতে ভ্যান কিংবা সিএনজি ব্যবহার করতে পারেন। আপাতত সিএনজি ব্যবহার করাই ভালো।

রিক্সায় গেলে একটি সুবিধা। সোঁদা মাটির ঘ্রাণ বেশি নিতে পারবেন। খড়কুটোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করবে। আশপাশে মচমচে পরোটা-ভাজি, মহিষের দুধের দই কিছুটা পুরনোর মধ্যে নতুনের আভাস দেবে। আমোদ নিয়েই কালাপানিয়া বেড়িবাঁধে চলে আসুন। এখানে তাঁবু গেড়ে নিতে পারেন। মেঘনার মোহনার তীরে জনমানবশুণ্য নারকেল-খেঁজুর গাছঘেরা কোনো স্থানে তাঁবু ফেলে দিন। স্থানীয়রা এখানে বেশ মিশুক। তাদের সঙ্গে ভাব মেশাতে বেগ পেতে হবে না। সবচেয়ে বড় কথা। ভ্রমণটা হবে আনন্দঘন।

দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছর ঘরেই জনবসতি রয়েছে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও মুগ্ধ হয়েছিলেন। একসময় এখানে লবণশিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছিল। তুর্কি সাম্রাজ্যের সুলতান পর্যন্ত সন্দ্বীপে নির্মিত জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ সংগ্রহ করেছিলেন। বহির্বিশ্বের ভ্রমণতরী ও বাণিজ্যিক জাহাজও সন্দ্বীপে নোঙর ফেলত। সেই সুবাদে পুর্তগিজদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে সন্দ্বীপের ওপর। গড়ে তোলে নিজেদের উপনিবেশ অঞ্চল। এরপর ১৬১৫ সালে পুর্তগিজদের সঙ্গে আরাকান রাজ্যের যুদ্ধে ২০০ সৈন্যসহ পর্তুগিজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত হলে তারা সন্দ্বীপ ছেড়ে গেলে, ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখলে নেয়। এরপর আরাকান ও মগদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের পরাধীনতা অস্বীকার করে এ অঞ্চল প্রায় অর্ধশতাব্দী রাজত্ব করে দেলোয়ার খাঁ। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতাসহ পৃথিবীর অনেক পর্যটক সন্দ্বীপের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে এখানটাতে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন।তাতে কোনো সন্দেহই নেই। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলেই তা বোঝা যায়। 

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রায় ৬৩০ বর্গমাইলের সন্দ্বীপ ক্রমাগত নদী-ভাঙনের শিকার হতে হতে বর্তমানে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে অবতীর্ণ মাত্র ৮০ বর্গমাইল আয়তনের নয়নাভিরাম সন্দ্বীপে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ক্যাম্পিং করে থাকার জন্য কালাপানিয়া, হরিশপুর ও রহমতপুর বেস্ট। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো। সারি সারি নারকেল, খেজুর গাছের ফাঁক গলে দিনে সূর্যের আর রাতে চাঁদের আলোয় মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অপার্থিব সুখে। এখানে ভ্রমণ মানে ক্যাম্পিং। এখানে ভ্রমণ মানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। এখানে আসা মানে প্রকৃতিকে দেখা। আবার এখানের মানুষের মুখ থেকে এর রুদ্রমূর্তি জানা। সন্দ্বীপ অনেক চেনা। কিন্তু আপনার কি চেনা?  

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন