বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আয়োজিত বাংলাদেশ-ফ্রান্স ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৩-এ ফ্যাশন শো’তে আমন্ত্রিত ছিলেন দুই দেশের কূটনীতিক ও বিশেষ দর্শক। আয়োজনের ফ্যাশন শোয়ের পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে প্যারিসের পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টাল প্যারিস লা গ্র্যান্ডের বলরুম। শো এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কিউরেশনের দায়িত্বপালন করেন আড়ংয়ের হারস্টোরির জ্যেষ্ঠ ডিজাইনার সামি আলম। তার সঙ্গে ইত্তেফাকের দীর্ঘ আলাপে উঠে এসেছে আয়োজনের নানা গল্প। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ফাতিন আহমেদ।
আয়োজনের আদ্যোপান্ত
ফ্যাশনের রাজধানী প্যারিসে দুই দেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব উদযাপনের আয়োজনের কাজটিতে সামি আলমকে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে। দুই দেশ থেকে দুটো দল অংশ নেওয়ায় সমন্বয়ের কাজ করেছেন তিনি। কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন খ্যাতনামা কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদ। ২০টি লুক সম্বলিত শোতে ১৫ জন মডেল ছিলেন ফ্রান্সের ও ৫ জন ছিলেন বাংলাদেশি। সহকারী ডিজাইনার হিসেবে পুরো প্রজেক্টে কাজ করেছে নিশান রহমান ও তাবাস্সুম মিম। আয়োজনের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন দেলফিন প্রফেশনাল ফ্যাশন শো অর্গানাইজার ও ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন একাডেমি অব প্যারিস এর ফ্যাশন ডিপার্টমেন্টের পরিচালক দুরিক্স।
ফ্যাশনের রাজধানীতে বাংলাদেশ
বাংলাদেশি ডিজাইনার হিসেবে দেশীয় দল নিয়ে ফ্রান্সের আরেকটি দলের সমন্বয়ে প্রথম ফ্যাশন শো সামি আলমের। এর আগেও ফ্যাশন গ্র্যাজুয়েট হিসেবে প্যারিসে ফ্যাশন শো করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। প্যারিসের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের অপেরা বলরুমের ইতিহাস ১৫০ বছরেরও পুরনো। ইতিহাসের অনেক বড় বড় কিংবদন্তি, আর্টিস্ট ও বিশ্ববরেণ্যদের পদার্পন ও কাজের পৃষ্ঠপোষকতা হয়েছে এই বলরুমে। এমন আইকনিক স্থানে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ফ্যাশন শো করতে পারা সামি আলমের জন্য বড় অর্জন অবশ্যই।
কাল্পনিক পৃথিবীর অভিজ্ঞতার ফ্যাশন শো
শুধু বাংলাদেশকে উপস্থাপনই নয়, কাল্পনিক দুনিয়ার অভিজ্ঞতা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আয়োজনে। অন্ধকার বলরুমের বড় পর্দায় পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নকশিকাঁথার মাঠের কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করার মাধ্যমে শুরু। তারপর ১০ জন মডেল সামি আলমের ডিজাইন করা পোশাক পরে বাংলা ফিউশন মিউজিক এর তালে হেঁটে যান। আবার অন্ধকার বলরুম। এবার ভেসে আসে ফ্রান্সের বিখ্যাত বই ‘লো পুতিত প্রান্স’ এর কিছু লাইন। আবার ১০ জন মডেল হেঁটে যান ফ্রেঞ্চ মিউজিকের তালে।
ফিনালেতে সব মডেলের মঞ্চে আগমন। সবশেষে সামি আলমের মঞ্চে প্রবেশ। মঞ্চে এসেই তিনি সর্বশেষ মডেলের পোশাকের পেছনে বেঁধে রাখা নকশিকাঁথার বাঁধন খুলে দেন। নকশিকাঁথাটি মঞ্চে জ্বলজ্বল করতে থাকে। সেখানে বড় করে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে প্যারিসের ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঐতিহাসিক অপেরা বল রুম।
বাংলাদেশ-ফ্রান্স বন্ধুত্ব: দুই সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অনুভূতির প্রকাশ
দুই সংস্কৃতির মধ্যে অবিচ্ছেদ্য অনুভূতির বিষয়টি প্রকাশের চেষ্টাই করেছেন সামি আলম। নিজে প্যারিসে ফ্যাশন গ্র্যাজুয়েট। তাই দুই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে রয়েছে পরিচয়।
ক্রিয়েশনের জায়গা থেকে এই কলেকশনে ফিউসন এসেছে টেক্সটাইল ও কনস্ট্রাকশনে। জামদানি, নকশি কাঁথা, মসলিন, পাট, লুঙ্গি, টাঙ্গাইল তাঁত, গামছাসহ কমবেশি দেশীয় টেক্সটাইলের কনটেম্পোরারি ব্যবহার পুরো কলেকশনে রয়েছে। দেশি টেক্সটাইলের সাথে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন মার্কেটে ব্যবহৃত ডেনিম, লেদার, শিফন, সুয়েড, গ্যাবার্ডিনসহ অনেক টেক্সটাইল ব্লেন্ড করে কনস্ট্রাকশন ও লুকে ফিউশন এসেছে।
ধারণাগত জায়গায় সামি আলমের কালেকশন বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটা কাল্পনিক রসায়ন গড়ার চেষ্টা করেছে। তার মতে, প্যারালাল ইউনিভার্স সৃষ্টির প্রচেষ্টা। কালেকশনে গ্রামবাংলার ছবি উঠে এসেছে, আবার কোথাও কোথাও বিভিন্ন চরিত্র যেমন কৃষক, নববধূ, বাউল, জমিদার-এর কনটেম্পরারি ফ্যাশন অনূদিত করা হয়েছে। অন্যদিকে ফ্রেঞ্চ রেভোলুশনের সময়ের ফ্যাশনের আমেজ রয়েছে কোথাও, ভিক্টর হুগোর উদৃতি রয়েছে রিক্সা আর্ট স্টাইলে। রয়েছে ফ্রেঞ্চ জনপ্রিয় বই "লো পুতিত প্রান্স" এর চরিত্র দা লিটল প্রিন্স।
কালচারাল ফিউশনের সফল আয়োজন
কালেকশন ডিজাইনের সময় সামি আলমের ছিল ভিন্ন ভাবনা। চিরাচরিত ব্যাকরণের বাইরে কিছু কাজ করেছেন তিনি। যেমন ফ্যাব্রিক ও কালারের সরাসরি সংযুক্তি না রাখা, কিংবা একটা সিঙ্গুলার ধাপে কোরিওগ্রাফ না করা, একই সাথে ক্যারেক্টার ও কনটেক্সট দিয়ে স্টোরিটেলিং করা। কালেকশনে 'ডিজরাপটিভ স্টোরিটেলিং' স্টাইল ব্যবহৃত হয়েছে।
সামি আলম আড়ং-এর হারস্টোরি ব্রান্ডে ফোকাস করছেন। পাশাপাশি ফ্যাশন এডুকেশনে কিছু করার ইচ্ছা আছে। দেশকে ফ্যাশনের আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বুকে লালন করেই কাজ করছেন।