উন্নত বিশ্বের কোনো নগর, সেখানকার গণপরিসর ও স্থাপনার দিকে তাকালে দেখা যায়, শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষও সেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে চলাচল করছে। হুইলচেয়ারে চড়েও তারা একাই স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তা পার হচ্ছে, কেনাকাটা করছে, সর্বোপরি প্রতিদিনকার জীবনে তারা কারোর বোঝা হচ্ছে না। এর বড় কারণ, সকলের কথা চিন্তা করে বসবাসযোগ্য ও মানবিক নগর নির্মাণ। যার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো 'সর্বজনীনগম্যতা', যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Universal Access। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো নির্মাণকে সবার জন্য সমান ব্যবহারোপযোগী করতেই এর প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে এই চিত্র পুরোপুরি বিপরীত। এমনকি ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডেও সবর্জনীনগম্যতার ধারণা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল না। স্থাপত্যচর্চায়ও অনেকসময় বিষয়টি আড়ালে থেকে যেতো। বড়জোর র্যাম্প বা লিফটের মাধ্যমেই তা সন্নিবেশিত করা হতো। তবে সবর্জনীনগম্যতা শুধু এটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক খুঁটিনাটি বিষয় রয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে সম্প্রতি তিন তরুণ স্থপতি ফাহিম হাসিন সহন, খতিব তানিজা বারি আকাশ এবং মোস্তাক আহমেদ মিলে 'বাংলায় সর্বজনীনগম্যতার নির্দেশনাবলি' তৈরি করেছেন। তারা মাস স্টুডিওর কর্ণধার। বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস-এর উদ্যোগে ও ইউএনডিপি এবং ডাইভারসিটি ফর পিসের অর্থায়নে নির্দেশনাবলিটি তৈরি করা হয়েছে। এতে রাস্তা, গণপরিবহন, পার্কিং, ফুটপাত থেকে শুরু করে ঘরের দরজা, সিড়ি, রেলিং, লিফট, র্যাম্প, খাবারের ঘর, রান্নাঘর, শৌচাগারসহ সব স্থানে সর্বজনীনগম্যতা নিশ্চিত করার ধারণা ছবিসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন সরকারিভাবেও অনুসরণ করা হচ্ছে এসব নির্দেশনা।
স্থপতি ফাহিম হাসিন বললেন, রাস্তার ফুটপাতে ব্যবহার করা লাল বা ধূসর টাইলসের মাঝে একসারি হলুদ বাটন টাইলস বসাতে দেখবেন। এটি কিন্তু সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নয়। বরং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সাদা ছড়ি দিয়ে দিক-নির্দেশক টাইলস ঠুকে ঠুকে যেন সামনে এগোতে পারেন, সেজন্য এই পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের শহরে অধিকাংশ ফুটপাতের ট্যাকটাইল টাইলস মিশে গেছে বিদ্যুতের খুঁটি বা গাছের গোড়ায়। আবার ফুটপাত থেকে ওঠানামার জায়গাগুলোও প্রয়োজনমাফিক ঢালু নয়, যা একজন প্রতিবন্ধী বা বয়স্ক মানুষের জন্য অসুবিধা তৈরি করে। স্থপতি খতিব তানিজা বললেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্যও আমাদের নগর বা স্থাপনার অভ্যন্তরের ধরন অসুবিধা সৃষ্টি করে। এমন অবস্থায়, যদি দুর্ঘটনায় কেউ আহত হন, একা হুইলচেয়ারে চড়ে বা ক্র্যাচ ব্যবহার করে চলাও তার পক্ষে কখনো সম্ভব হয় না। বয়স্কদের চলাচলেও যে বাড়তি সুবিধাটুকু প্রয়োজন, সেটা আমরা দিতে পারি না। ফলে বৃদ্ধরা নিজেদের অন্যের বোঝা ভাবতে শুরু করেন। এমন চিত্র পরিবর্তন করতে হলে সার্বজনীনগম্যতা সম্পর্কে জানতে হবে।
স্থপতি সহন, আকাশ ও মোস্তাক ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর করছেন একসঙ্গেই। তাঁরা জানালেন, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে সর্বজনীনগম্যতার একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা ছিল, যা সাধারণ মানুষের জানার বাইরে। তাই তাঁরা প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় সর্বজনীনগম্যতার বিশদ ও সচিত্র বিবরণ তৈরি করেছেন। এটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতেও কাজ করছেন তারা। এছাড়া বিভিন্ন স্থাপত্যে প্রকল্পের পরামর্শক-স্থপতি, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোও ইদানীং সর্বজনীনগম্যতা নিরীক্ষা বা অডিটের ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে। যার মাধ্যমে একটা স্থাপনা ঠিক কতটুকু Accessible —তা যাচাই করা যাচ্ছে। এতে করে সচেতনতাও বাড়ছে।
নগর ও গণপরিসরের বিষয়টি বোঝা গেল। এবার প্রশ্ন আসতে পারে, কেউ যখন নিজের বাড়ি বানাবেন বা ছোট পরিসরে কোনো নির্মাণ করবেন, তখন এই নির্দেশনা অনুসরণ করলে তিনি কীভাবে লাভবান হবেন। জবাবে স্থপতি মোস্তাক বলেন, আজ হয়তো আপনি তরুণ, সম্পূর্ণ সুস্থ, এবং চলাচলে সক্ষম। কিন্তু যেকোনো দুর্ঘটনায় আপনার স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কিংবা একসময় বয়স হবে। তখন যদি আপনার বাড়ির সিড়ি, বেডরুম, টয়লেট, রান্নাঘর বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গা 'সর্বজনীনগম্য' হয়, তবে আপনাকে এর ব্যবহার নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হবে না। অন্যের সাহায্য ছাড়াই দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে পারবেন। স্থাপত্য নকশার ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে কয়েকটি বাড়তি মাপজোকের প্রয়োগ ঘটালেই আপনার স্থাপনাটি এসব গুণাবলী অর্জন করবে। অনলাইনে www.buag.info ওয়েবসাইটে গেলে ছবি ও বিস্তারিত তথ্যসহ দেখতে পাবেন বাংলা ভাষায় সর্বজনীনগম্যতার আদ্যোপান্ত।