সম্প্রতি ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতি শিক্ষাপ্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হলো প্রাকৃতিক উপকরণে ঘর তৈরির ভিন্নধরনের এক কর্মশালা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ একদল স্থানীয় তরুণ-তরুণীর অংশগ্রহণে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নানা আকৃতিতে বাঁশ কেটে সাজিয়ে রাখছেন তাদের কেউ কেউ। কেউ ব্যস্ত বেতের পাটিতে নানারকম চিত্রকর্ম আঁকতে। কাউকে দেখা গেল বাঁশে দড়ি বেঁধে তৈরি করছেন ঘরের কাঠামো। মূলত প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে কম খরচে পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা।
OSUN ক্লাইমেট এডুকেশন গ্রান্ট, ওয়ার্ল্ডওয়াইড টিচ-ইন অন ক্লাইমেট অ্যান্ড জাস্টিস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ যৌথভাবে এই কর্মশালা আয়োজন করে, যার শিরোনাম 'জিরো-কার্বন ব্যাম্বু বিল্ডিং'।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতির স্থানীয়দের সঙ্গে দুই দফা মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন স্থাপত্যের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সিদ্ধান্ত হয়, বাঁশের তৈরি ঘরটি সেখানকার কিশোর-কিশোরী সাঁতারু দলের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহার হবে, পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এটিকে খেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করবে। এরপর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হয় কর্মশালা। ১৩ মার্চ দিনব্যাপী শেখানো হয় বাঁশ কাটা থেকে শুরু করে বাঁশ ব্যবহার করে দেয়াল বুনন ও বিভিন্ন কৌশল। প্রশিক্ষণে শেখা পদ্ধতি অনুসারে বাঁশের ঘর তৈরি করেন শিক্ষার্থীরা।
এ ধরনের আয়োজনের পেছনে রয়েছেন পাকিস্তানের প্রথম নারী স্থপতি ইয়াসমিন লারি। গত তিন দশক ধরে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদেরকে কম খরচে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে ঘর তৈরি করতে শেখাচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারীদেরকে সাশ্রয়ী উপায়ে জীবনধারণের নানা পদ্ধতি শেখান লারি। পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা এ স্থাপনাগুলো লারির নামেই 'লারি অক্টাগ্রিন' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের হবু ও নবীন স্থপতিরাও তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বিশেষত দুর্যোগ কবলিত এলাকায় এমন স্থাপনা খুব কার্যকর। ঘরগুলোর আয়ুষ্কাল হবে ১৫ থেকে ২০ বছর। যেহেতু প্রিফেব্রিকেটেড, প্রয়োজন অনুসারে এটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরও করা যাবেI
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক জায়নাব ফারুকী আলীর নেতৃত্বে এবং প্রভাষক ইম্মাত আরা খানম ইমার তত্ত্বাবধানে এই কর্মশালায় যুক্ত ছিলেন স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষাদান সহকারী সানজিদা আক্তার রুমকি, তারান্নুম মাহমুদ, নির্বাহী সহকারী সাদেকুল আরেফিন সাইফ, শিক্ষার্থী হাফসা তাসনিম আলী, সৈয়দা সুমাইয়া নাসরিন, রুয়াইদা আক্তার, নুসাফেরিন বিজেতা, জিনান বিনতে হক, যুলকারনাইন সহ আরও অনেকে। এছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীও এতে অংশ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন প্রাকৃতিক উপাদানের বাড়ির ছোট কয়েকটি মডেল। শেষ সাতদিনের কর্মশালায় সবাই মিলে তৈরি করেছেন প্রিফ্যাব্রিকেটেড ‘অক্টাগ্রিন’ ধাচের ঘর। আগা খান অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবির এবং স্থপতি সুহায়লী ফারজানার সার্বিক নির্দেশনায় পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
বাঁশ ও বেত ব্যবহার করে তৈরি করা ঘরটিতে মূল কাঠামো বাঁশের হলেও দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে বেত। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা রঙতুলির আঁচড়ে বেতের গায়ে এঁকেছে নিজেদের পছন্দের ফুল, গাছ, পাখি, পাতাসহ আরো অনেককিছু। এছাড়াও তারা ঘরটির পাশের পুরোনো ২টি দেয়ালকে রাঙিয়েছে মনের মতো করে।
কর্মশালা শেষে ঝিনাইদহের পৌর মেয়র প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক জায়নাব ফারুকী আলী বলেন, ‘দুই দশক পেরিয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মানবিক ও পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরিতে উৎসাহ দিয়ে আসছি। বাঁশ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে ঘর তৈরি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। ফলে এতে কোনো কার্বন নিঃসরণ হয় না। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের স্থপতিদেরকে এ ধরনের কাজে আরও উৎসাহ দিতে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে I উল্লেখ্য, ২০২২ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের আয়োজনে দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগ তৈরী করেছে এরকম আরও সাতটি ‘অক্টাগ্রিন’ ঘর। লন্ডনেও এটি তৈরিতে অংশগ্রহণ করেছে তারা।
স্থাপত্য বিভাগের প্রভাষক ইম্মাত আরা খানম ইমা বলেন, 'আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে আমরা পরিবেশ নিয়ে কেউই চিন্তিত নই। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা আপনার, আমার এবং আমাদের সকলের দায়িত্বI অক্টাগ্রিন প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরাই সেই বার্তা দিতে চেয়েছি।