বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মানুষ ও বৈশ্বিক পরিবেশ সংরক্ষিত হোক

আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৫০

কয়েক দিন আগে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (MIST) প্রফেসর মো. মোখলেসুর রহমান স্যার আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ছবি পাঠিয়েছিলেন এবং ফোন করে অনুরোধ করে বলেছিলেন যে, আপনি যেহেতু লেখালেখি করেন, এ ছবিটির ওপর ভিত্তি করে একটা লেখা তৈরি করতে পারেন। ছবিটি ছিল তিনটি প্রাণীর নিবিড়ভাবে একসময় ঘুমিয়ে থাকা নিয়ে। তিনি বারবার বলছিলেন যদি তিনটি প্রাণী একসঙ্গে থাকতে পারে, তাহলে মানুষ কেন পারবে না।

মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। এর পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে। মানুষ জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের দিক থেকে অন্যদের থেকে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ। কিন্তু বিগত শতাব্দী ও বর্তমান শতাব্দীর মানুষের কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে বিশ্বনেতাদের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম দেখে একটু ভিন্নতর চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন মনে হয়, সময় এসেছে মানুষকে প্রাণিকুল, উদ্ভিদরাজি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র্রাতিক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে শিক্ষা নেওয়ার।

বর্তমান বিশ্বে যে সংখ্যাক পারমাণবিক বোমা, জীবাণু অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র, জঙ্গি বিমান ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হচ্ছে এবং মজুত আছে, সেগুলো দিয়ে এ পৃথিবীকে কয়েক বার ধ্বংস করা যাবে। সেগুলো মানুষ তার স্বজাতির ওপর ব্যবহার করবে। আর এসব যুদ্ধ ও যুদ্ধে ব্যবহূত বিস্ফোরক, ব্যয়িত জীবাশ্ম জ্বালানি, তেজস্ত্রিয়তার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমেই বাড়ছে।

যুদ্ধের কারণে কেউ কেউ তাদের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, কোনো দেশ বা জাতির সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। ভাবমূর্তির সংকট হলে সে জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলতে পারে না এবং পারবে না। জাতিসংঘের সুদানের দারফুরে ইউনামিড মিশনে বাংলাদেশ ফরমড পুলিশ ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে প্রায় ১৩ মাস আল-জেনিনা মরুভূমিতে কর্মরত ছিলাম। খুব কাছ থেকে মানুষের অমানবিক জীবনযাপন দেখেছি, দেখেছি শিশু সৈনিকের যুদ্ধসাজ, দেখেছি বাড়িঘরের শতসহস্র গুলির ক্ষতের চিহ্ন।

সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও সর্বশেষ ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা পৃথিবীর সভ্যতা, নৈতিকতা, মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। ফিলিস্তিনে ও ইউক্রেনে মানবতা ব্যাপকভাবে অবনমিত হয়েছে ও হচ্ছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধের কারণে জাতিসংঘ, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা ও বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাসমূহ ব্যর্থ হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে গেছে! জাতিসংঘের অনেক সফলতাও আছে। কিন্তু জাতিসংঘের পাশাপাশি বিশ্বনেতারা তথা বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেই এসব যুদ্ধ বন্ধ করা যাবে।

একটা সূত্র থেকে জানলাম, যুদ্ধে ইউক্রেনের ৭ লক্ষাধিক সৈন্য ও সার্ভিসম্যান মারা গেছেন, অন্যদিকে রাশিয়ার পক্ষে ৩ লাখ ১৫ হাজার সৈন্য মারা গেছেন। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যু, আহত হওয়া ও পঙ্গু হওয়া তো হিসাবের বাইরে। অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, ইসরাইলের বোমায় ফিলিস্তিনের অনেক মানুষ, বিশেষ করে শিশু, নারী মারা গেছে ও ধ্বংসস্তূপের নিচে বহু শিশু, নারী ও অন্যদের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। রুয়ান্ডার এক গেরিলা কমান্ডার পরবর্তী সময়ে রুয়ান্ডার সরকারের এসপি হয়ে জাতিসংঘে চাকরি নিয়ে আমাদের দারফুরের বাংলাদেশ কনটিজেন্ট ইন্সপেকশনে এসেছিলেন। তিনি একটা গল্প বলছিলেন, গল্পটি ছিল রুয়ান্ডার যুদ্ধকালীন, যেখানে স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন গোত্রের ছিলেন, আর সন্তান জন্ম হলো মায়ের চেহারার আদল নিয়ে, সেজন্য বাবা সন্তানকে হত্যা করল। রুয়ান্ডার সে কমান্ডার আরো বলেছিলেন যুদ্ধমানুষকে অসুস্থ (সিক) করে ফেলে। সেজন্য পৃথিবীর যে কোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করে নেয়া উচিত। আশ্রয় শিবিরে বছরের পর বছর বাস করার কারণে মৌলিক চাহিদা থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়। উপরন্তু মানুষ তার মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সে কারণে সে যে কোনো কিছুই করতে পারে।

মানুষ বিভিন্ন প্রাণী থেকে অনেক শিক্ষা নিয়েছে, তিমি মাছের পানির ওপরে ভেসে ওঠা এবং আবার পানির নিচে চলে যাওয়া দেখে মানুষ সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ আবিষ্কার করে। আবার পাখির আকাশে ওড়া দেখে অ্যারোপ্লেন আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ হয়। একটা কাকপাখি মারা গেলে শত শত কাকের শোক প্রকাশ এবং একটা বানর মারা যাওয়ার পর অনেক বানরের সে স্থানে সমাবেশ আমরা দেখেছি। হাজারো মৌমাছির একসঙ্গে বসবাস থেকে আমরা সত্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

আমার মানবাধিকার ও পরিবেশ নিয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ হয়েছে। আমরা বুঝতে পারি না মানুষ এতটা হিংস্র অমানবিক ও অবিবেচক হয় কী করে! সূত্র থেকে জানা যায়, চলমান ইসরাইল ও হামাস যুদ্ধের কারণে ফিলিস্তিনের গাজায় পানি, মাটি, বাতাস, পানির সাপ্লাই ও স্যানিটেশন ব্যাপক মাত্রায় দূষিত হয়েছে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইসরাইল কর্তৃক সহস্রাধিক টন বিস্ফোরক ফিলিস্তিনের গাজার ওপর নিক্ষেপিত হয়েছে। তাছাড়া যুদ্ধযানে ব্যবহূত জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে ব্যাপক কার্বন নিঃসারণ হচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে!

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের ১ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনভূমি এখন যুদ্ধক্ষেত্র। বিরল প্রজাতির উদ্ভিদসমূহ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন, পাখিরা তাদের বাসা ত্যাগ করতে এবং যুদ্ধের কারণে স্বাভাবিক অভিবাসন রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। বনভূমিতে আগুন, বন উজাড়, বিস্ফোরণ, বনভূমি উজাড় করে দুর্গ নির্মাণ, মাটি ও পানিতে বিষক্রিয়া সবকিছুই বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থলকে এবং বন্যপ্রাণী ও জীব বৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম ৭ মাসে ১০০ মিলিয়ন টন কার্বন বায়ুমণ্ডলে যোগ হয়। উল্লেখ্য যে, এ কার্বন হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম অনুঘটক।

কার্বন থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড উত্পন্ন হয়, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস হিসেবে ভৃপৃষ্ঠে তাপমাত্রা ধরে রাখে ও বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী। তাই এ কার্বন উত্পাদন ও নিঃসারণ বন্ধ করতে হবে। সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি, চলাচল ও জলযুদ্ধ সামুদ্রিক শৈবাল, ফনা (Fauna) এবং ফ্লোরা (Flora) ও জলজ প্রাণীসমূহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা এক অপূরণীয় ক্ষতি। গ্রিনহাউজ প্রভাবের কারণে অ্যান্টার্কটিকা এবং হিমালয় ও অন্যান্য পর্বতের বরফ গলা শুরু হয়ে যাবে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করবে, যার ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুুজীব সৃষ্টি হবে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী ত্বকের ক্যানসারসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হবে। কয়েকটি দেশ ও বাংলাদেশের এক বিশাল অংশ সমুদ্রের পানির নিচে চলে যাবে!

যুদ্ধের কারণে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ছে, পানি, মাটি, পলি, বাতাস ও শব্দ দূষিত হচ্ছে। সে কারণে আগামীতে পৃথিবীতে অনাবৃষ্টি, সুনামি ও বন্যা দেখা দেবে। সাম্প্রতিক কালে অ্যান্টার্কটিকার বড় বড় হিমাবাহ ও বরফ গলা শুরু করেছে। যার ফলে ঐ সব হিমবাহে বসবাসকারী প্রাণীকুল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে ও ক্রমে ক্রমে এ সবুজ পৃথিবী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক পরিবেশবিজ্ঞানী বর্তমানে চলমান এসব যুদ্ধকে পরিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধমর্মে আখ্যায়িত করেছেন। সেজন্য পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিবর্গ, পরিবেশকর্মী, পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যুদ্ধ বন্ধে কাজ করা উচিত।

পরিশেষে বলতে হয় ইগো, হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ এবং অসহিষ্ণুতা দূর করে সব জাতি গোষ্ঠী মিলে পাশাপাশি বাস করতে হবে এবং যুদ্ধকে না বলতে হবে। কবির সেই বিখ্যাত উক্তি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’—এ সত্য সবাইকেই উপলব্ধি করতে হবে।

লেখক: কমান্ড্যান্ট (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল, বেতবুনিয়া, রাঙ্গামাটি, বাংলাদেশ পুলিশ

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন