দীর্ঘ সময় সিডনিতে বসবাস করি। কিন্তু আমার কাজকর্ম বা জীবনযাপনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে চট্টগ্রাম। যৌবনের শেষ প্রান্তে দেশ ছেড়ে আসা মানুষ তার জন্মভূমিকে ভুলবে কীভাবে? যত দেশ বা শহর-নগরে যাই না কেন, চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালেই আমার বুক স্ফিত হয়ে যায়। আমি নিঃশ্বাস নিতে নিতে অনুভব করি, কেমন একটা ভালো লাগা আমাকে আচ্ছন্ন করে থাকে। এর নাম প্রেম বা মায়া যা-ই বলি না কেন, এটাই সত্য। সে কারণে আমরা যারা চট্টগ্রামের মানুষ, আমাদের দিন শুরু হয় স্থানীয় দৈনিক আজাদী পাঠ করে। নামে স্থানীয় হলেও এর প্রচারসংখ্যা বহু জাতীয় দৈনিকের চেয়ে বেশি। গুণমানে ও প্রসারে এটি একটি জাতীয় দৈনিক। এমন প্রভাব চট্টগ্রাম নানা খাতে দেখিয়ে আসছে।
সেদিন আমার মতো অনেক মানুষের মনে বেদনা ও রাগের সঞ্চার করেছিল একটি খবর। গাছ কাটা বাংলাদেশে স্বাভাবিক বিষয়। তার আগে বলি, সবুজের সমারোহে বাংলাদেশ খারাপ কিছু না। আমি যত বার কলকাতা বা ওপার বাংলার নানা শহরে যাই, আমার এখন মনে হয় আমাদের সবুজ তাদের চাইতে বেশি। এবং তা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ গাছ কাটার খবরগুলো মর্মান্তিক। আসুন, ঘটনাটা জেনে নেই। বিডি নিউজের একটি লেখায় দেখছি: সিডিএর সঙ্গে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ সাক্ষাত্ করে গাছ না কাটার বিষয়ে আলোচনা করে। ঐ আলোচনার পর সিডিএ জানিয়েছে, আপাতত গাছ কাটার বিষয়টি তারা স্থগিত করেছে এবং র্যাম্পের পুনর্নকশার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপাতত উল্লিখিত সড়কে র্যাম্প না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সিডিএকে ধন্যবাদ। একই সঙ্গে পুনর্নকশা এবং সেই নকশা সর্বজনের জন্য উন্মুক্ত করে সবার মতামত গ্রহণের মাধ্যমে চূড়ান্তকরণের সিদ্ধান্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামের এই সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে যে, এক্সপ্রেসওয়ের এই উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নকশা আগে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। পূর্বের নকশার ক্ষেত্রে মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। আর তাই গাছ কাটার সর্বনাশী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিডিএ। এ ঘটনা একই সঙ্গে সিডিএকে আরো বেশি জনবান্ধব ও পরিবেশমুখী হওয়ার বার্তা দেয়। জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে সিডিএর গাছ বাঁচানোর এই সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
এই আশাবাদের পাশপাশি এই খবরও আছে যে, ইতিমধ্যেই প্রায় ৫০টি গাছের শরীরে লাল কালির মৃত্যুদণ্ড আঁকা হয়েছে। গাছ কাটা বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী গণমাধ্যমকে জানান, উন্নয়নকাজ করতে গেলে কিছু গাছ কাটা পড়ে। তিনি আরো জানান, আউটার রিং রোডে ২০ হাজার গাছ কাটা পড়েছিল, কিন্তু পরে লাগানো হয়েছে ৫ লাখ। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, জমি ব্যবহারের জন্য রেলের অনুমতির পাশাপাশি বন বিভাগের কাছে গাছ কাটার অনুমতিও চেয়েছে সিডিএ।
উন্নয়ন ও পরিবেশ কখনো পরস্পরবিরোধী হতে পারে? আমি জানি, সিডনি বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলবে না। আমরা এই শহরে গাছের মায়ায় জীবন কাটাই। সব উন্নত দেশেই আমরা এমনটা দেখি। বহু বছর আগে বামপন্থি একজন লেখকের একটি ভাষণ শুনেছিলাম। অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমেদ আঞ্চলিক টানে শুদ্ধ বলতেন। চট্টগ্রামের মানুষ। তিনি চীন দেশ ঘুরে এসে তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তার বিস্ময় লেগেছিল শীতকালে সে দেশের বড় বড় গাছে কাপড় বাঁধা আর যত্ন নেওয়ার ধরন দেখে। কোথাও কোথাও লবণের পুঁটলি বেঁধা গাছকে বরফের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা দেখে তিনি বলেছিলেন, আমরা মানুষকেই বাঁচতে দিই না, গাছ তো দূরের কথা। চীনারা গাছ বাঁচিয়ে নিজেদের পরিবেশ বাঁচায়। আমরা নিধন করে উন্নতি করতে চাই। এটা কেমন ব্যাপার?
দেশের কথাই বলি। আমার পিতা ছিলেন খুব সাধারণ একজন মানুষ। ব্যাংকের কাজ সেরে এসে গাছ লাগানো আর গাছের পরিচর্যা করা ছিল তার শখ। আমাদের বাসার সঙ্গে লাগোয়া সবুজ একফালি উঠানে নানা ধরনের গাছ লাগাতেন বাবা। কী গাছ, কোন গাছ কিছুুই জানতাম না। একদিন দেখি ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েক জন এসে হাজির। বাসায় থাকায় আমিই গেলাম তাদের সঙ্গে কথা বলতে। তারা হাতে করে কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলেন। একজন কোনো কথা না বলে বাগানে ঢুকে একটি বিশেষ গাছের গোড়ায় পোস্টার সেঁটে দিলেন। তাতে লেখা ছিল, এই গাছ কর্তন বা বিক্রয় নিষিদ্ধ। পরে জানলাম, এটি দুর্লভ প্রজাতির কোন এক গাছ, যা মানুষের জন্য ভালো, পরিবেশের জন্য উত্তম। সেই সুনজর বা সুদৃষ্টির ভবিষ্যত্ কী হয়েছিল জানেন? সেই উঠান, বাগান সব নির্মূল করে সেখানে গড়ে উঠেছে এক কমিউনিটি হল। যেখানে বিয়ে, জন্মদিন বা অন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবার গিয়ে আমি সেই জায়গা চিনতেই পারিনি। সবুজময় সেই মাঠ আর গাছ কর্তন করে লাভ লেইন হয়ে গেছে হতশ্রী।
এটাই আমাদের নিয়তি। যে গাছ কাটা নিয়ে হইচই, তার অবস্থান এমন এক জায়গায়, যার ছায়ায় এখন পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলে। আমাদের যৌবনে দলবদ্ধ না হয়ে আমরা সে এলাকায় যেতাম না। চারদিকে গাছময় শান্ত এক নিরিবিলি পরিবেশ। সন্ধ্যার পর গা ছমছম করা নীরবতা। সেই নীরবতা টুটে গেছে অনেক আগে। এখন সেখানে সন্ধ্যার পর কপোত-কপোতী আর তারুণ্যের মিলনমেলা। সেই মিলনের আশ্রয় আর নির্ভরতা দেওয়া গাছগুলো কেটে র্যাম্প বানানোর মধ্যে কী আধুনিকতা জানি না। কিন্তু সেটাই করতে বসেছিল সিডিএ বা উন্নয়নকর্তারা। এমনটা আগেও হয়েছিল। শিরীষতলা নামে খ্যাত এই জায়গার মহিরুহগুলো প্রায়ই দেখি তোপের মুখে পড়ে। তোপের মুখে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। কিন্তু কত দিন তারা এভাবে বাঁচতে পারবে?
আর দশটা জায়গার মতো এখানেও আসলে উদাসীনতা আর জেদি মনোভাব কাজ করে, যা উন্নয়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যারা এগুলো কাটতে আগ্রহী, তারাও এ দেশের নাগরিক। তাদের সন্তানসন্ততি, পরিবার-পরিজন এমনকি নিজেদেরও অক্সিজেন দরকার। সবুজ উধাও হয়ে আসা চট্টগ্রাম নগরী এমনিতেই ইট-কাঠের শহরে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের এই শহরের রাস্তাঘাটগুলোর নাম ছিল ঝাউতলা, কদমতলী, কাঁঠতলী, মেহেদীবাগ। নামেই বোঝা সম্ভব কেন এমন নাম ছিল এদের। আজ আপনি একটি রাস্তায়ও তেমন কোনো গাছ দেখবেন না। আমাদের কৈশোরে দেখা বড় বড় সাগুগাছ খেজুরগাছ ঝাউগাছ কবেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। এখন ১০০-২০০ বছরের যে গাছগুলো ইতিহাস ও অতীতের প্রমাণ আমাদের গর্ব, তাদেরও থাকতে হচ্ছে ভয়ে ভয়ে। অথচ এই গাছগুলো আমরা তো বটেই, আমাদের পিতা-প্রপিতামহেরাও লাগাননি। তারও আগে কে বা কারা এদের দিয়ে স্বর্গ রচনা করতে চেয়েছিলেন, সেই স্বর্গকে নরক বানিয়ে কী আসলেই উন্নয়ন সম্ভব? আমাদের দেশের উন্নয়ন যেমন সত্য, তেমনি সত্য গাছ বাঁচানো। পরিবেশ ঠিক রাখা। এটা কি আমরা মানব না?
লেখক: সিডনিপ্রবাসী