প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থ বারের মতো জয়লাভ করে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সরকারি সফরে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মিউনিখ যান। সেখানে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন এবার ৬০তম বার্ষিকী পালন করেছে। দীর্ঘ এই সময়ে সম্মেলনে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে।
এবারের সম্মেলনেও বিশ্বনেতারা গুরুত্বপূর্ণ অনেক আন্তর্জাতিক বিষয়, যেমন বৈশ্বিক অর্থনীতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি বেশ কয়েক জন বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠক করেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলত্জ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্করটে, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-থানি এবং ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের উদ্বোধন হয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের রয়েছে দীর্ঘ ৬০ বছরের ইতিহাস। ১৯৬৩ সালে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো থেকে মূলত অংশগ্রহণ করা হতো এবং এ সম্মেলনের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের যেসব হুমকি ও নিরাপত্তাসংকট ছিল, সেগুলো নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যেই মূলত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠার সময়টিই বলে দিচ্ছে, স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলনের উৎপত্তি এবং বরাবরই সম্মেলনটি একটি অনানুষ্ঠানিক প্ল্যাটফরম, যার মাধ্যমে ইউরোপের নিরাপত্তার বিষয়গুলো তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত হয়েছে।
এবার এর সম্মেলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, এখানে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, রাজনীতিক, কূটনীতিক একত্র হয়েছিলেন এবং একটি অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। প্রথম কয়েক দশক আলোচনা মূলত স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাবের মধ্যেই সীমিত ছিল এবং সেখানে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মুখ্য বিষয় ছিল এবং তাকে কেন্দ্র করে ইউরোপের উদ্বেগ ও শঙ্কা ছিল।
আমরা জানি, ইউরোপ তখন পশ্চিম ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপে বিভক্ত ছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে ছিল এবং এখনো যা বজায় আছে। এ সম্মেলন ইউরোপভিত্তিক একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, যেটি ইউরোপের নিরাপত্তা এবং চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করে। সেখান থেকে বিভিন্ন বিষয় আলোচনার পর পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু গত দুই বছর অর্থাত্ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিত, আলোচ্য বিষয় এবং নিরাপত্তা সম্মেলনের ভবিষ্যত্ করণীয় সবকিছুই পালটে যায়।
ফলে বর্তমান বিশ্বের একটি জটিল সময়ে এ নিরাপত্তা সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এটি অতীতের চেয়ে অনেক বড় পরিসর ধারণ করেছে। এ সম্মেলনটি একসময় পশ্চিমা দেশগুলোকে কেন্দ্র করে হলেও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দেশ সেখানে অংশগ্রহণ করছে। পুতিন একসময় নিয়মিত এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলেও এখন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে তার অবস্থান।
এ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ফ্রম পকেট টু প্ল্যানেট :স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনায় বক্তৃতা ও ছয়টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
এই প্রস্তাবগুলো হলো
১. উন্নত দেশগুলোকে পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি মেনে চলা।
২. বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে, যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে।
৩. জলবায়ুর প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করা।
৪. বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থ প্রাপ্তি সুগম করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাটি তাদের সক্ষমতায় বিনিয়োগ করার সুযোগসহ সমাধান করা।
৫. বৈশ্বিক অর্থায়নের ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঋণের বোঝা দূর করতে তাদের জন্য অনুদান ও সুবিধাজনক লাভের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থপূর্ণ ফলাফল দেখানো।
৬. জলবায়ু কর্মসূচির জন্য বেসরকারি পুঁজিপ্রবাহের জন্য সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকল্পের জন্য বেসরকারি পুঁজি আকৃষ্ট করার জন্য আহ্বান জানানো।
এবারের আলোচনার মূল বিষয় ছিল মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদন ২০২৪, যার শিরোনাম হচ্ছে Lose-Lose অর্থাত্ নিরাপত্তার দিক থেকে বিশ্ব এমন একটি অবস্থানে আছে, যে পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চল ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে।
এবারের মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে—এখানে তারা বলেছেন, সবাই পরাজিত হচ্ছেন। ইউরোপ, ইন্দো-প্যাসেফিক, আফ্রিকা কিংবা এশিয়া এসব অঞ্চলের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এই সম্মেলনে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যে সম্মেলন হয়েছে, সেখানে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সম্মেলনের বা এজেন্ডার প্রসার ঘটেছে। এবারের সম্মেলন ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের যে সংকট সেটি সামনে উঠে এসেছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয়টিও। সেখানে চীন ও রাশিয়ার প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেছে। সেদিক থেকে এটি যে একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা কূটনীতির মঞ্চ, তাতে সন্দেহ নেই।
লেখক :অর্থনীতিবিদ ও গবেষক