সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ফগারের ধোঁয়ায় মরছে না মশা

  • মশার কামড়ে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী
  • ওষুধ আমদানি জালিয়াতিতে বিপুল গচ্ছা উত্তর সিটির
  • নিজেদের সফল বললেও মশা কমেনি দক্ষিণেও
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৪, ০৮:০০

রাজধানীতে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রেল স্টেশন, লঞ্চঘাট, বিপণিবিতান, বাস টার্মিনাল এবং বাসাবাড়িতে মশার দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। ঘনবসতি এলাকায়ও মশার দাপট। মশা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।

এদিকে এবার মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ায় ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে সতর্ক করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু নির্দেশনা অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে নগরবাসীর মধ্যে ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়ার আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির দাবি করেন, মশা নিয়ন্ত্রণে তারা সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে উত্তর সিটি করপোরেশন মশা নিধনের ওষুধ ক্রয় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে এখনো মশা নিধনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। যদিও মেয়র আতিকুল ইসলাম  বলেন, ভবিষ্যতে এটি যেন না হয় এজন্য তারা কাজ করছেন। নতুন করে ওষুধ ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে তিনি জানিয়েছেন। কত দিনে এ প্রক্রিয়া শেষ করে ওষুধ আমদানি করে মশা নিধনের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি দেওয়া যাবে সেটি নিশ্চিত নয়।

প্রসঙ্গত, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য সিংগাপুর থেকে মশা নিধনের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আমদানিকারককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ঐ আমদানিকারক সিংগাপুরের পরিবর্তে জৈব কীটনাশক বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই নিয়ে আসে চীন থেকে। এই ওষুধ গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। যদিও এই জালিয়াতি সামনে এলে পরবর্তী সময়ে এ ওষুধ প্রয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত বছরের ৩ আগস্ট কীটনাশক বিটিআই প্রয়োগ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। আর এই প্রয়োগ বন্ধ করার পর নতুন করে এই বিটিআই আমদানি করা হয়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল-বিকাল যে পরিমাণে লোকালয়ে বা স্থাপনায় ওষুধ দেওয়া প্রয়োজন, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাঝেমধ্যে বিকালে কিছু কিছু এলাকায় মশা মারার নামে ফগার মেশিনের ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। এতে মশার দাপট আদৌ কমছে বলে নগরবাসী বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দাবি করেন, দক্ষিণ অঞ্চলের পুরোদমে মশা দমনের কাজ চলছে। 

এ বিষয়ে তারা সফল দাবি করে বলেন, সকালে লার্ভাসাইডিং এবং ফগিং করা হয়। আগামী মে মাস থেকে আরও জোরালোভাবে এডিস মশা নিধনের কাজ শুরু হবে। তাদের ওষুধ ভারত ও চীন থেকে এনে মজুত করা হয়েছে। এ বিষয়ে উত্তরের মেয়র বলেন, সিটি করপোরেশন নিজস্ব উদ্যোগে বিটিআই আমদানি করবে। এতে করে আর জালিয়াতির কোনো সুযোগ থাকবে না। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক আছি, মশক নিধন কার্যক্রম চলমান আছে।

উল্লেখ্য, রাজধানীর ১৯৬.২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ড। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেটে নগরীতে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং এ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কিনতে ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছিল ৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা। ডিএনসিসির মতো ডিএসসিসিও বছর জুড়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কর্মসূচি পালন করেছে বলে জানায় তারা। ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোসহ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে।

রাজধানীর ডোবা-নালা ও জলাশয়ে জন্ম নেয় কিউলেক্স মশা। প্রায় ৯৫ ভাগ প্রজনন হয় এ উৎস থেকে। যেগুলো আবার বেশির ভাগের মালিক সরকারি সংস্থা। অথচ এসব জলাশয় পরিষ্কার ও সঠিক তদারকির অভাবে বাড়ছে কিউলেক্সের উপদ্রব।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এখন ঢাকায় ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা। এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক হওয়ায় মানুষ অতি সতর্ক থাকেন। কিন্তু কিউলেক্সের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। দেশের ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ মশার এই প্রজাতি ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের জীবাণু বহন করে। এছাড়াও কিউলেক্স মশার কামড়ে চর্মরোগও হয়ে থাকে। আর এই মশার ‘গুন গুন’ শব্দ ও কামড় অস্বস্তিকর। বেশি উপদ্রবের সময় স্বস্তিতে কোনো কাজ করতে পারে না মানুষ। নগরবাসীকে রোগ-ব্যাধি ও অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ দিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এডিসের জন্য যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে, তেমন তত্পরতা দেখা যাচ্ছে না কিউলেক্সের ক্ষেত্রে। বছর জুড়ে বিস্তার লাভ করা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সংস্থার ব্যর্থতা সবার কাছে পরিষ্কার। কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ এ খাতে বছরে শতকোটি টাকার বেশি জনগণের রাজস্ব খরচ করছে সংস্থা দুটি।

দুই সিটির দাবি, প্রতিদিন সকাল ও বিকালে মশা নিয়ন্ত্রণে তারা কীটনাশক ব্যবহার করছে। লার্ভা নিধনে সকালে কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। আর বড় মশা নিধনে বিকালে ফগিং করা হচ্ছে। তবে এ কার্যক্রম যথাযথভাবে করা হচ্ছে না বলে অভিমত কীটতত্ত্ববিদদের। তাদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণ একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ। প্রজনন মৌসুম বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু দুই সিটির কার্যক্রমে তার ঘাটতি রয়েছে।

ইত্তেফাক/এমএএম