প্রতি বছর নতুন নতুন চাহিদা বাড়ায় বড় হচ্ছে ঈদের অর্থনীতি। ঈদ সামনে রেখে সেজে উঠেছে রাজধানীসহ দেশের ছোট-বড় বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলো। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী এখন কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে বাড়ছে ঈদের অর্থনীতির আকার। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে আছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বোনাস। ২ কোটি প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্স ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বোনাস। এ পরিমাণ টাকার সবই ঈদ অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মার্চ মাসের প্রথম ১৭ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১১৬ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স আসছে বিগত কয়েক মাসের তুলনায় বেশি। ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স আরো বেশি আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত প্রবাসীরা আপনজনদের কাছে ঈদ উত্সব পালনে বাড়তি টাকা পাঠাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, আগামী তিন মাস পর্যন্ত রেমিট্যান্সের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। রোজার ঈদের পরই শুরু হবে কোরবানি ঈদের প্রস্তুতি। সেই সময়ও প্রবাসীরা বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠাবেন। এর ফলে ডলার-সংকট কেটে বাড়বে রিজার্ভ। দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাড়াতে হলে এখন ডলারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ঈদ ঘিরে সেই ডলার-সংকট কাটবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্যবসায়ীরা সারা বছর এই সময়ের জন্য মুখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। ফলে ঈদ ঘিরে ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন বিনিয়োগ করছেন। করোনার কারণে বিধিনিষেধের মুখে গত তিন বছর ব্যবসায়ীরা সেভাবে মুনাফা করতে না পারলেও এবার তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে আশা করি। বিশেষ করে পাইকারি মার্কেটের পর এখন খুচরা পর্যায় থেকে ভোক্তারা সাধ্যমতো কেনাকাটা করছেন। ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ অনেক বাড়াচ্ছেন। ফলে রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। ডলার-সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য যখন চাপের মুখে, তখন ঈদের কারণে আমরা ডলার পাচ্ছি। এটা সবচেয়ে ভালো দিক।
পাইকারি মার্কেটগুলোতে শবেবরাতের আগে থেকে বেচাকেনা শুরু হয়। ঐ সময়ে বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল, ফ্যাশন হাউজ ও শোরুমগুলোর খুচরা বিক্রেতারা পাইকারদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করেন। তবে এবার শবেবরাতের পর থেকে ভোক্তারা ঈদের কেনাকাটা শুরু করেছেন। বিশেষ করে, দর্জিপাড়াখ্যাত রমনা ভবন, গাউছিয়া মার্কেটের দোতলা, নিউ মার্কেটের দ্বিতীয় তলাসহ ঢাকার অন্যান্য এলাকায় কারিগররা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। ভোক্তাদের অর্ডারমতো নতুন নতুন পোশাক বানাচ্ছেন দর্জিরা। এছাড়া রোজার প্রথম দিন থেকেই মার্কেটগুলোতে ভিড় বেড়েছে। প্রবাসী ভাইবোনদের জন্য আগেভাগে পোশাক কিনে অনেকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, ঈদ উপলক্ষ্যে সারা দেশের ২৫ লাখ দোকানে কেনাকাটা চলছে। মুদি থেকে শুরু করে এসব দোকানের মধ্যে কাপড়ের দোকান, শোরুম ও ফ্যাশন হাউজগুলোও রয়েছে। এসব দোকানে বছরের অন্য সময় প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হলেও রোজার মাসে সেটি তিন গুণ বেড়ে হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ঐ হিসাবে রোজার এক মাসে এই ২৫ লাখ দোকানে ঈদ পোশাক থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হবে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় পোশাকের বাজারে। পোশাকের দোকানেই ঈদের কেনাকাটা এবার ৮০ হাজার কোটি থেকে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। শুধু তা-ই নয়, ঈদ ঘিরে অর্থনীতির সব খাতেই গতি ফিরে এসেছে।
ঈদের মাসে যেমন সারা দেশের শপিংমল বা মার্কেটগুলো গতিশীল হয়, তেমনি সারা দেশের কুটিরশিল্প, তাঁতশিল্প, দেশীয় বুটিক হাউজগুলোয় বাড়ে কর্মচাঞ্চল্য ও আর্থিক লেনদেন। বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতিশীলতা আসে। ব্যাংকিং খাতে লেনদেন বাড়ে ব্যাপক হারে। এদিকে মানুষের চাহিদা পূরণে বাজারে অতিরিক্ত নতুন নোট ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা ও যানজটের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের অনলাইন বাজার। রোজার আগে অর্থনীতিতে একধরনের প্রভাব থাকে। আর রোজা শুরুর পর থাকে আরেক ধরনের।
রোজার আগে অর্থনীতি সচল থাকে ভোগ্যপণ্যকেন্দ্রিক। এ মাসে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রোজা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই মূলত শুরু হয় রোজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি। কেননা রোজার জন্য পণ্য আমদানি কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু করতে হয় ব্যবসায়ীদের। এ দেশের মানুষ উত্সব পৌষ-পার্বণে কেনাকাটা করে থাকেন। বিশেষ করে ঈদের সবারই নতুন কিছু চাই। ফলে সেভাবেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের উত্পাদন ও আমদানি করে থাকেন। আমরা আশা করছি, এবার খুচরা পর্যায়ে রেকর্ড বেচাবিক্রি হবে। নানা সংকটের কারণে অর্থনীতি এখন চাপের মুখে রয়েছে। তবে ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনায় সেই চাপ সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবেন ব্যবসায়ীরা।
এবারের ঈদে শীর্ষ ১০ পণ্যের কেনাকাটায় দেড় লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঈদ কেনাকাটার সবার শীর্ষে থাকবে পোশাক। এর পরই জুতা-স্যান্ডেল, লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছা। খাদ্যপণ্যের মধ্যে সেমাই-চিনি, মাংস, মিষ্টি, গ্রোসারি পণ্য রয়েছে। প্রসাধনী, ইলেকট্রনিকস টিভি, মোবাইলসহ নানা ধরনের পণ্যও কেনা হয় ঈদ উপলক্ষ্যে। অনেকে আবার সোনার গয়না, ঘরের আসবাবপত্র কেনেন বলে ঈদে এসব পণ্যের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যায়। এর বাইরে ঈদের ছুটিতে পর্যটন খাতেও মানুষ অর্থ ব্যয় করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি পরিবার ন্যূনতম থেকে ১০-১৫ হাজার টাকা ব্যয় করে ঈদকে ঘিরে। সামর্থ্য অনুযায়ী এই অঙ্ক আরো বাড়ে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঈদে পোশাকসহ পরিধেয় খাতে থেকে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ কোটি, জুতা-কসমেটিকস ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্য ৭ হাজার কোটি, জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত ৩৮ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি, সোনা-ডায়মন্ড ৫ হাজার কোটি, ভ্রমণ খাতে সাড়ে ৫ হাজার কোটি, ইলেকট্রনিকস ৪ হাজার কোটি, স্থায়ী সম্পদ ক্রয় ১ হাজার কোটি, পবিত্র ওমরাহ পালন ৩ হাজার কোটি, আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য খাতে লেনদেন হয় আরো ১ হাজার কোটি টাকা। তবে এফবিসিসিআইয়ের পাশাপাশি আরো কয়েকটি সংগঠন থেকে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার ঘোষণা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এবার নিরুত্সাহিত করা হলেও রাজনৈতিক দলসহ নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইফতার পার্টির আয়োজন করছে। এটিও অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক। খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহন খাতে বাড়তি এই অর্থ যোগ হবে। অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায়, এবার ঈদ বাজারকে ঘিরে দেশের অর্থনীতি আরো চাঙ্গা ও গতিশীল হচ্ছে।
লেখক :বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড