শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

সমাজ অস্থির কেন

আপডেট : ২৪ মে ২০২৪, ০৮:১৫

দেশে সামাজিক অস্থিরতা ক্রমশ বাড়িতেছে। সংঘাত, সংঘর্ষ, হত্যা, হানাহানি নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হইয়াছে। নৃশংস হয়ে উঠিতেছে মানুষ। তুচ্ছ কারণেই একজন আরেক জনকে হত্যা করিতেছে। পারিবারিক কলহ হইতে যেমন খুনখারাবির ঘটনা ঘটিতেছে, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণেও নানা লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হইতেছে। সামাজিক অস্থিরতাসংক্রান্ত গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলি রীতিমতো উদ্বেগজনক। গতকাল দেশের সংবাদমাধ্যমগুলি পূর্ণ ছিল শিহরন জাগানো নানা ঘটনায়! সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্য বীভত্সভাবে হত্যার শিকার হইয়াছেন, যাহা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। যেইভাবে তাহাকে খুন করা হইয়াছে, তাহা যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়! অন্যদিকে, নরসিংদীতে এক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে নির্মমভাবে পিটাইয়া হত্যা করা হইয়াছে। এই সকল ঘটনায় যখন চারিদিকে তোলপাড় চলিতেছে, তখন রাজধানীর পূর্বাচলে বেড়াইতে লইয়া যাওয়া স্ত্রীকে উবার চালক স্বামীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শিহরিত করিয়া তুলিয়াছে দেশবাসীকে। প্রতিদিনই এই ধরনের সাক্ষী হই আমরা। এই সকল প্রবণতা কীসের আলামত?

দেশে গত ছয় মাসে আড়াই হাজারের অধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। এই সকল ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হইয়াছে সহস্রাধিক। মূলত সামাজিক নানা ইস্যুর সূত্র ধরিয়াই সংঘর্ষের এই সকল ঘটনা ঘটিতেছে। সমাজ-জীবনে অস্থিরতা এইভাবে হুহু করিয়া বৃদ্ধি পাইবার পিছনে অর্থনৈতিক কারণ যেমন আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণও। নাজুক অর্থনীতির এই কালে সামাজিক অস্থিরতায় বহুলাংশে ইন্ধন জোগাইতেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সাধারণত দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা না থাকিলে তাহার বিরূপ প্রভাবের শিকার হয় ব্যক্তিজীবন। ইহার সরাসরি প্রভাব পড়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণে—আজিকার দিনে ঠিক ইহাই পরিলক্ষিত হইতেছে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

সনাতন সমাজব্যবস্থা হইতে আমরা আধুনিক সমাজব্যবস্থায় পদার্পণ করিয়াছি বটে; কিন্তু মডার্ন সোসাইটির রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনের প্রতি কি আমাদের লক্ষ আছে? রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসাম্য, দ্বন্দ্ব, লোভ ও হতাশার বশবর্তী হইয়া হত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটাইয়াও অনেকে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়া বাহির হইয়া যায়—ইহা বর্তমানকালের একটি ট্রেন্ড বটে। আরেকটি গুরুতর ট্রেন্ড হইল, আইন আদালতের রাস্তায় হাঁটিয়া ন্যায়বিচার আদৌ পাওয়া যাইবে কি না, ইহা লইয়া জনমনে একধরনের ‘শঙ্কা’ রহিয়াছে, যাহার ফলে অনেকে আইন হাতে তুলিয়া লইবার দুঃসাহস করিয়া বসে! মানুষ আইনের শাসনের কথা ভাবিবার চাইতে নিজেই ফয়সালা করাকে শ্রেয় মনে করে। ইহাই যেন আজিকার সমাজের প্রতিচ্ছবি।

সামাজিক বন্ধনের শিথিলতাই সমাজে এহেন অস্থিরতার অন্যতম কারণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দায়িত্বসচেতন নাগরিক গড়িয়া তুলিবার যেই সুস্থ ধারার কথা বলা হয়, অনেক পূর্ব হইতেই সেইখানে আমরা ব্যর্থ। একইভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে পারিবারিক ঐতিহ্য বা শিক্ষার ধারাবাহিকতাও বিনষ্ট হইয়াছে নানান প্রেক্ষাপটে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার ইইতেও প্রয়োজনীয় নৈতিক শিক্ষা পাইতেছে না এই প্রজন্ম। ইহার ফলাফল সুমিষ্ট হইবে না স্বভাবতই। এই সামাজিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারিলে মানুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হইবে। রাষ্ট্র ও সমাজের উপর আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পাইবে, যাহা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। রাতারাতি অবস্থার উত্তরণ ঘটিবে—এমন কথা আমরা বলিতে চাহি না। তবে সামাজিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব ইহা হইতে মুক্তির উপায় খুঁজিতে হইবে। পবিত্র কুরআনে সুরা আল-মা’আরিজের একটি অংশে বর্ণিত আছে, ‘মানুষকে সৃষ্টি করা হইয়াছে খুবই অস্থির-মনা করিয়া, বিপদ তাহাকে স্পর্শ করিলে সে উত্কণ্ঠিত হইয়া যায়’। অর্থাত্, মানব-মনে অস্থিরতা অস্বাভাবিক কিছু নহে। এই ক্ষেত্রে ধৈর্যই আসল হাতিয়ার। হাদিসের বাণীও সেই কথা বলে—‘ধৈর্য এমন একটি গাছ, যাহার সারা গায়ে কাঁটা কিন্তু ফল অতি সুস্বাদু’। সুতরাং, সর্বাবস্থায় আমাদের ধৈর্য রাখিতে হইবে।

ইত্তেফাক/এসটিএম