সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

পরিবার থেকেই অবসান হোক নারী বৈষম্য

আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১৬:২০

রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার। পরিবারের ঘরের কর্মযজ্ঞের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। নেই কোন অবসর, অর্জন, অনুপ্রেরণা অথবা কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রাপ্তি। পরিবারের এই অসীম পরিসীমায় নারীই একাকী দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু গৃহকর্মে নারীর শ্রমকে স্বীকৃতি না দিইয়ে তার দায় হিসেবেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। পুরুষ শাসিত প্রশাসনের নির্দয় নিষ্পেষণ এটি। সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা নারীর ওপর এই বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে বহুদিন ধরে।

বৈষম্যের এই অবকাঠামোকে আরও শক্তিধর করেছে ক্ষমতার অপব্যবহার। এই বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয় আপন গৃহ থেকেই। গৃহের সীমাহীন কর্মের প্রায় সিংহভাগই চাপানো হয় নারীর ওপর। এক্ষেত্রে তার মেধা, সামাজিক অবস্থান, শারিরীক বা মানসিক ক্ষমতা, বয়স, শিক্ষা কোনকিছুই ধর্তব্যে আনা হয় না। একজন অফিস ফেরত কর্মকর্তা পুরুষ তার প্রতিদিনের কর্ম প্রহর শেষে  ঘরে ফিরে বিশ্রাম নেবেন এটাই স্বাভাবিক। সেই সাথে তার প্রশান্তি, বিনোদন এবং তৈরি খাবারও নিশ্চিত থাকবে এটাও চিরায়ত। পক্ষান্তরে অফিস ফেরত নারী কর্মকর্তাটি ঘরে ফিরেই সবার দেখভালে সরব এবং সক্রিয় হয়ে উঠেন। নিমেষেকালীন সময়ও বিশ্রামের সুযোগ পান না তিনি। তাকে তড়িঘড়ি ছুটে যেতে হয় রান্নাঘরে। অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েও  দিনশেষে তাকে হতে হবে নিখাদ গৃহবধূ। হোক না সে তিন মাসের বাচ্চা আগলে রাখা রাত জাগা নিদ্রাহীন তরুণী অথবা আসন্ন প্রসূতি অথবা রক্তশূন্যতায় ভোগা দূর্বলতম কোন চাকরিজীবি নারী। এমন কি গৃহে আগত অতিথিরাও তারই আপ্যায়ন ও সেবা যত্মের অপেক্ষায় থাকেন।

অনেক ক্ষেত্রেই চাকরিজীবি স্ত্রী তার স্বামীর চেয়েও বেশি পরিশ্রম এবং উপার্জন  করেন কিন্তু তারপরেও গৃহকর্মে নীতি নির্ধারক পুরুষ সঙ্গীটির বিবেকহীন এই বৈষম্যগুলো তাকে নতমুখে মেনে নিতে হয়।তিনি কোনপ্রকার বিশ্রাম বা বিনোদনের অবকাশ পান না। মেধা,দক্ষতা ও যোগ্যতার উন্নয়নকল্পে ন্যুনতম পড়ালেখার সুযোগও তাকে দেয় না এই মাত্রাধিক ঘরকন্নার কর্মযজ্ঞ। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে কর্মজর্জরিত তথা অর্ধমৃত অথবা ক্রমশ অক্ষম করে পরোক্ষভাবে সমাজ এবং রাষ্ট্রের উপরই অক্ষমতার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন তারা। এই অক্ষম অথবা বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠী কোন উন্ময়নেই শরীক হতে পারে না।

লৈঙ্গিক বৈষম্যের সুবিধাভোগী পুরুষ সমাজ তাদের অবস্হান খুব সহজে ছেড়ে দেবে না একথা যেমন সত্যি তেমনি লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার নারী সমাজের এই বঞ্চনাও কোনমতেই গ্রহনযোগ্য নয় এ কথাও কঠোর সত্যি। এর মাঝেই দীর্ঘ সময় কালক্ষেপণ করেছি আমরা। এখন মুক্তি চাই,  যে স্বৈরতন্ত্র নারী মুক্তির অন্তরায় তার থেকেও পরিত্রান চাই।

পুরুষতন্ত্র শক্তি এবং মেধায় নারীকে খাটো করে দেখছে শুরু থেকেই। এই প্রবনতা মেধাদীপ্ত নারীকেও অবমূল্যায়নের শিকার হতে বাধ্য করছে। গৃহকর্মের  স্বীকৃতি এবং গৃহস্হালি কাজের মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখবে নারী মুক্তির আন্দোলনে। নারীর শারীরিক, মানসিক,সাংস্কৃতিক অগ্রয়ায়নের পথেও তা সহায়ক ভূমিকা রাখবে। মজুরিবিহীন গৃহস্হালি কাজের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি করেন নারীই। নারীর উদয়াস্ত বিরামহীন কর্মের ভিত্তিতেই টিকে আছে সমাজ ও সংসার। উল্লেখ্য নারী সমাজের অনেক সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সমাধান কল্পে অনেক মহান পুরুষদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। খুব ছোট এবং সাধারণ আঙ্গিকে একটি পারিবারিক সমঝোতার মত করেই আন্দোলন শুরু হোক। পরিবারের সব সদস্যদের সানন্দ অংশগ্রহন  থাকুক গৃহকর্মের প্রতিটি আয়োজনে। পুরুষেরা শারীরিক শক্তিতে এগিয়ে।  তাদের অংশগ্রহণে পারিবারিক কর্মপ্রহর যেমন আনদ ঘন হবে তেমনি নারী সদস্যদের  শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্হ্যেও তা গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে।পুরুষ কর্তৃক অধিকৃত ক্ষমতার অপসারণ ও ভারসাম্য  রক্ষাও  হবে এই  সুসম কর্ম বন্টনের মধ্য দিয়ে। নারী নির্যাতনের হারও অনেকাংশে কমে যাবে । পারবরিক সহিংসতা কমে যাবে এবং  সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধন বৃদ্ধি পাবে।

বদলে যাওয়ার বদলে দেয়ার দিন সবার  দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। প্রয়োজন আত্ম- সমালোচনা,আত্মসংশোধন এবং আত্মশুদ্ধির। প্রতিটি শিশুপুত্রের মনেই গেঁথে দিতে হবে পরিবারের সবাই সমান তাই সব কাজ সবাইকে ভাগ করে করতে হবে।জীবনের শুরু হতেই কন্যা এবং পুত্র সন্তানকে একে অন্যের প্রতি সহমর্মী থেকে একই সাথে গৃহকর্মে অংশ নেয়া শেখাতে হবে। ভারসাম্যর আলোয় আলোকিত গৃহ তথা রাষ্ট্র ও পৃথিবী চাই, যে পরিবার নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তি সুরভিত বাসস্থান হবে।

লেখক: ডা. প্রফেসর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমা বেগম নাজু (অব)

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib