ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা লেখা কীভাবে সহজ হয়েছে, সে গল্প নতুন করে না বলি। বাংলা ভাষাভাষী প্রত্যেকেই যারা কম্পিউটার, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তারা অভ্র কি-বোর্ডের কথা জানেন। বেশিরভাগ ব্যবহারকারী এটিও জানেন যে, এই অভ্র কি-বোর্ডের নির্মাতা ডাক্টার মেহদী হাসান, যিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় দিন-রাত প্রোগ্রামিং ও কোডিং করে এই সফটওয়্যার তৈরি করেছিলেন।
এর আগে বাংলা লিখতে হতো একেক হরফের বিভিন্ন বোতাম টিপে, যা আয়ত্ত্ব করাও কষ্টসাধ্য ছিল। অথচ ইউনিকোড টাইপিংয়ের সফটওয়্যার অভ্রের ফোনেটিক মেথডে লেখা এতোই সহজ যে, ইংরেজিতে 'Amar Sonar Bangla' লিখলে তা বাংলায় 'আমার সোনার বাংলা' হয়ে আসে। অভ্র যখন ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হয়, তখন থেকেই বাংলা লেখায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসা শুরু করে। ব্লগ, পরবর্তীতে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীদের যা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। অথচ সফটওয়্যারটি এতবছরেও এক টাকা মূল্য নেয়নি। কারণ এর নির্মাতা মেহদী হাসান মনে করেন, রক্ত দিয়ে যে ভাষা অর্জন করা হয়েছে, তা ডিজিটাল মাধ্যমে লিখতে অর্থ লাগবে কেন!
এরপর গত এক যুগে প্রতিবার ভাষার মাস এলেই মেহদী হাসানকে পুরষ্কৃত করার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। মেহদীর হয়ে একুশে পদকের জন্য তথ্য জমা দিতেও চেয়েছেন অনেকে। কিন্তু নীরবে-নিভৃতে থাকা মেহদী কখনো এতে রাজি হননি। সরকার বা সংশ্লিষ্ট মহলও বিষয়টি সেভাবে বিবেচনায় নেয়নি। অবশেষে এবছর 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি' ক্যাটাগরিতে একুশে পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে মেহদী হাসানকে। এই খবরে আনন্দ প্রকাশ করেছেন অসংখ্য মানুষ। তবে মেহদী এবারও এতে সম্মত হবেন কিনা, সে ব্যাপারে খানিকটা সন্দেহ ছিল।
অভ্র কি-বোর্ডের পেজ থেকে দেওয়া এক পোস্টে মেহদী লিখেছেন, 'একুশে পদকের খবর পড়লাম। আমি দেশের বাইরে। শত শত ইমেইল পেয়েছি। সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। ২০০৩ সালে যখন অভ্রর কাজ শুরু করলাম তখন অভ্র বা আমাকে কেউই চিনতো না। একটা ফোরাম বানালাম মানুষের টেকনিক্যাল সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্য। ইউনিকোডের ব্যবহার তখনো নতুন, হাজারটা সমস্যা। ধীরে ধীরে মানুষ জমতে শুরু করলো অনলাইন ফোরামে, তারা সমস্যা নিয়ে আসেন, আমি সমাধান বের করার চেষ্টা করি, অথবা bug থাকলে ঠিক করে নতুন রিলিজ দিই। কিছু মানুষ, আমি যাদের চিনি না, তারাও আমাকে চিনে না, এরা শুধু সমস্যা নিয়ে আসার বদলে ধীরে ধীরে বাকিদের সমস্যা সমাধানে আমার সাথে যোগ দেওয়া শুরু করলো। একসময় অনলাইন ফোরামের বাইরে এদের সাথে দেখা করলাম। সবাই ছাত্র তখন আমরা। কোন কারণে অভ্রর মিশনটায় তারা বিশ্বাস করেছে, এর বাইরে আর কোন চাওয়া পাওয়া নাই তাদের।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'আমি সবাইকে খুশি করতে পারবো না। কিন্তু দলের কাজের কৃতিত্ব একক ব্যক্তি না পাক, আমার সামর্থ দিয়ে এটুকু চেষ্টা করতে পারি। তাই উপদেষ্টা ফারুকী ভাইকে ফোন করে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করেছি। শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত আমরা যারা একসাথে কাজ করেছি— রিফাত, সিয়াম, শাবাব, এদের ছাড়া আমি অভ্রর নামে একুশে পদক গ্রহণ করতে পারবো না।'
এ ব্যাপারে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, 'মেহদী হাসান খানের সাথে আমার খুবই আন্তরিক আলাপ হয়েছে। আমরা জানতাম, মেহদী হাসান খান পুরস্কার গ্রহণ করতে আগ্রহী না। এর আগেও তাঁকে অ্যাপ্রোচ করা হয়েছিলো। তিনি পুরস্কার না নিতে পারেন জেনেও আমাদের ক্যাবিনেট থেকে আমরা পুরস্কার ঘোষণা করতে সম্মত হই। এর মাধ্যমে আমরা বার্তা দিতে চেয়েছি আমরা কাদের সেলিব্রেট করবো।'
ফারুকী আরও উল্লেখ করেন, 'তাঁর সাথে যখন কথা হয়, তিনি তখন অসম্মতই ছিলেন। ফাইনালি তিনি পুরস্কার নিতে সম্মত হন। কিন্তু তিনি একা এই কৃতিত্ব নিতে চাননি। তাঁর আরও তিন বন্ধু- রিফাত নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম এবং শাবাব মুস্তাফা— যাঁরাও অভ্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাদের ছাড়া তিনি পুরস্কার নিতে চাননি। আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি, স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যাওয়া এই চার গুণীকেই অভ্র’র জন্য দলগতভাবে একুশে পদকে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁরা চার বন্ধুই পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশে আসছেন পুরস্কার গ্রহণ করতে।'
এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে মেহদী হাসান বলেছেন, 'পরের প্রজন্মের জন্য অভ্রর মিশনটা যদি রেখে যেতে হয়, সাথে আমাদের টিমওয়ার্কটাও উদাহরণ হিসেবে থাকুক। একা একা তো বেশিদূর যাওয়া যায় না। ভালো হলো শেষমেশ। অভ্রর জন্য একুশে পদকের দাবি নিয়ে অনেকে অনেক বছর ধরে অনলাইনে ক্যাম্পেইন করছেন, আপনাদের দাবি পূরণ হলো। পদক তো একটা প্রতীক বা উপলক্ষ, এই উপলক্ষে সবার একসাথে হওয়া হবে আবার।'
মেহদী হাসানদের সম্মানিত করলে সম্মানিত হয় রাষ্ট্র। মেধাবী, দেশপ্রেমিক এই মানুষটি ও তার সতীর্থদের প্রতি শ্রদ্ধা।