মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ইফতার-শরবত জন্মবৃত্তান্ত!

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ১৩:০৮

ইফতারে ঠিক কবে থেকে শরবতের প্রচলন শুরু হয়েছিল, তা বলা বড্ড মুশকিল! ইতিহাস খুঁজলে, প্রথম শরবতের কথা পাওয়া গিয়েছিল ফারসি লেখক ও চিকিত্সক ইসমাইল গড়গানির ‘জাকিরেয়ে খোয়ারজামশাহি’ বইতে। ঐ বইয়ে ইরানের বিভিন্ন রকম শরবতের বর্ণনা দেওয়া ছিল। বইটিতে আরো উল্লেখ ছিল, আঙুরের শরবত, ডালিমের শরবত, পুদিনার শরবতসহ হরেক রকম শরবতের কথা।

মূলত, শরবত শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘শরবা’ ও ‘শরিবা’ থেকে। শরবা অর্থ পানীয় আর শরিবা অর্থ পান করা। এই দুখানা শব্দ থেকে প্রথম আসে ‘শেরবেত’ নামের একটি তুর্কি শব্দ। তুর্কি শেরবেতই ধীরে ধীরে হয়ে যায় শরবত, ইন্টারেস্টিং!

প্রাচীনকালে ঘন শরবতের প্রচলন ছিল। খেতে হতো চামচ দিয়ে কেটে। ফল শুকিয়ে তার নির্যাস থেকে সিরাপ তৈরি করা হতো, এরপর সিরাপ রেখে দেওয়া হতো বছরের পর বছর। সেই সিরাপই পরবর্তী সময়ে শরবতে রূপান্তর করা হতো।

২০০ বছর আগে উপমহাদেশের মানুষের কাছে শরবত পৌঁছেছিল! দিল্লির জামে মসজিদের আশপাশের এলাকা থেকে তরমুজ ও গোলাপের রস দিয়ে আগত নামাজিদের একধরনের পানীয় দেওয়া হতো, তার নাম ‘মহব্বত কা শরবত’।

তাছাড়া ওসমানীয় আমলে ইসলাম ধর্মের বিধি অনুযায়ী দেশগুলোতে মদ্যপান নিষিদ্ধ থাকার ফলে মুসলমানরা মদ ছেড়ে শরবতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ধীরে ধীরে মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শরবত। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘তামারিন্দ শারবেত’। এটি মূলত তেঁতুলের শরবত।

ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানে ‘জাল্লাব’ নামের একধরনের শরবতের প্রচলন ছিল। মিশর ও ফিলিস্তিনিতে ‘ক্যারব’ নামে একধরনের ফল পাওয়া যায়। শরবতকে বলা হয় ‘ক্যারব জুস’।

সুদানে ‘হেলো মুর’ নামে একধরনের শরবত পাওয়া যায়। দেশটির মানুষের কাছে এটি ভীষণ প্রিয় বিশেষ করে ইফতারে। সিরিয়ার আরো একটি জনপ্রিয় শরবতের নাম ‘কামার আল-দ্বীন’।

শরবত নিয়ে রয়েছে নানান মজার গল্প। ১৪ শতকের শেষের দিকে নিজের জন্মভিটা সমরকন্দ উদ্ধার করতে গিয়ে উজবেকদের তাড়া খেয়েছিলেন মোগল সম্রাট বাবর। এরপর ভারতবর্ষে এসে ঘাঁটি গাড়েন ও দিল্লির মসনদে বসেন। ওদিকে মসনদে বসেও সম্রাট বাবরের মন নাকি খালি শরবত শরবত করত। বাহারি ফল আর তার নির্যাস, ফুল, শিকড় দিয়ে তৈরি সেই সিরাপে বাবর মুগ্ধ ছিলেন! শরবতের স্বাদ বাড়াতে তিনি হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দিল্লিতে বরফ আনিয়েছিলেন। ঐ বরফডোবানো শীতল শরবত পান করে তৃপ্তি পেতেন সম্রাট। শুধু বাবর নন, তার পরবর্তী সম্রাটদের কাছেও শরবত ছিল প্রিয় পানীয়। আস্তে আস্তে ভারতবর্ষে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে শরবত, যার শুরুটা হয়েছিল বাবরের মাধ্যমে। আবার শোনা যায়, সম্রাট নিরোর নাকি শরবতপ্রীতি ছিল। বিশেষ এক ধরনের শরবত পান করতেন তিনি। বরফের সঙ্গে মধু মিশিয়ে সম্রাট নিরোর জন্য প্রস্তুত করা হতো ঐ শরবত।

১৯০৬ সালে গাজিয়াবাদের হামদর্দ ল্যাবরেটরি থেকে ফল-ফুল আর ভেষজ দ্রব্যের নির্যাস থেকে তৈরি করেন সুস্বাদু শরবত, যার নাম ‘রুহ আফজা’। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন হাকিম আব্দুল মজিদ। গ্রিক চিকিত্সক ‘হিপোক্রিতিসের’ দর্শন অনুযায়ী এটি করেছিলেন তিনি। রুহ আফজার নাম ছড়িয়েছিল রোজার মাসে। ইফতারে পানীয়টি সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিতে দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায় ভারতীয় তথা আমাদের দেশে।

শরবতের নানান গুণ রয়েছে আমাদের শরীরে। সারা দিন না খেয়ে রোজা থাকার ফলে শরীরে শর্করার স্তর অনেকটা কমে যায়। আর আমাদের মস্তিষ্কের প্রধান খাবারই হচ্ছে গ্লুকোজ। ইফতারে এক গ্লাস ফলের শরবত আপনার মস্তিষ্কের জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে। ক্লান্ত পেশিকে সতেজ করে ভিটামিন-ও মিনারেল। এক্ষেত্রে ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফলের পটাশিয়াম স্নায়বিক দুর্বলতা দূর করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলের জলীয় অংশ শরীরের পানিশূন্যতা দূর করে শরীরের প্রতিটি কোষকে কর্মক্ষম রাখে। শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরে ফ্রি-র‍্যাডিকেল তৈরি হতে বাধা দেয় এবং সৃষ্ট মৃতকোষ অপসারণ করে। ফলে কোষের ইমিউনিটি বৃদ্ধি পায়।

ইফতারে ঢাকার খাবারে প্রায় ১৫০ বছর আগে যে মৌসুমেই হোক না কেন, পুদিনাপাতা, ক্ষীরা, ধনেপাতা ও আখের রস পাওয়া যেত। আর সেসব হামানদিস্তায় থেঁতো করে গোলাপ বা কেওড়া ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে সুবাসিত করা হতো। সঙ্গে থাকত, ফালুদা ও তোকমার শরবত!

আধুনিক সময়ে আমরা নানা ধরনের শরবত দেখি। এমনকি বাণিজ্যিকভাবে শরবত তৈরি হচ্ছে। কিন্তু রমজান ঘিরে শরবতের যে আনন্দ, তা সেদিনও যেমন ছিল, আজও ঠিক তেমনি, একই রকম আছে।

লেখক :সংস্কৃতিকর্মী

ইত্তেফাক/এএম