বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মুরগি জবাইয়ের ফলে মাংসে জীবাণুর উপস্থিতি বাড়ছে। এতে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের একটি গবেষণায় ময়মনসিংহ সদর ও আশপাশের বিভিন্ন বাজারে সাধারণভাবে জবাইকৃত মুরগির মাংসে টাইফয়েড (সালমোনেলা) এবং কলেরা (ইকোলাই) জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই জীবাণুগুলোর উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষত যদি সঠিকভাবে মাংস প্রক্রিয়াজাত না করা হয়।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ময়মনসিংহ জেলার স্থানীয় বাজারে মাংসের নমুনাগুলোতে সালমোনেলা ও ইকোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক পরিমাণে। যেখানে এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত মাংসে থাকা উচিত নয়, সেখানে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ছিল লগারিদম ৪.০২ থেকে ৫.৫৯ সিএফইউ/গ্রাম এবং ইকোলাই ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ছিল লগারিদম ৪.০১ থেকে ৫.৯৪ সিএফইউ/গ্রাম পর্যন্ত। এছাড়াও, নমুনাগুলোর মধ্যে টিভিসি বা মোট কার্যকর ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণও বেশি ছিল।
বাকৃবি পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেনের নেতৃত্বে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনটি ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শাখা আয়োজিত '১৩তম আন্তর্জাতিক পোলট্রি সেমিনার-২০২৫'-এ উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণাটি ময়মনসিংহ সদর ও এর আশপাশের ১২টি বাজারে পরিচালিত হয়েছে। এ বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছে-ময়মনসিংহ সদরের চরপাড়া বাজার, মিন্টু কলেজ বাজার, মেছুয়া বাজার, নতুন বাজার, সানকিপাড়া বাজার, কেওয়াটখালী বাজার, শেষমোড় বাজার, সুতিয়াখালী বাজার, ভাবখালী বাজার, কে আর মার্কেট, শম্ভুগঞ্জ বাজার এবং গাছতলা বাজার।
গবেষণায় উঠে আসে যে, স্থানীয় বাজারগুলোর বেশির ভাগ পোলট্রি দোকানে মুরগি রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই, ৮৪.৬২ শতাংশ দোকানে ময়লা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই এবং ৪৬.১৫ শতাংশ দোকানে পর্যাপ্ত আলো নেই। এর ফলে সঠিকভাবে মাংস সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না, যার ফলে জীবাণু বৃদ্ধি এবং দূষণের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। গবেষণায় আরো বলা হয়, ৩০.৭৭ শতাংশ দোকানে মাংস কাটার জায়গা অস্বাস্থ্যকর ছিল এবং পরিকল্পিত বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল না, যা জীবাপুর বিস্তার ঘটায়।
অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানীয় বাজারের পোলট্রি দোকানে অপর্যাপ্ত জায়গায় মুরগি রাখা হচ্ছে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জবাই করা হচ্ছে। এই পরিস্থিাতি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। এর সমাধানে স্থানীয় বাজারগুলোতে ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাংস পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।'
তিনি আরো বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে, স্থানীয় বাজারগুলোতে ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হলে, তা নিরাপদ মাংস সরবরাহ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি স্থানীয় পোলট্রি দোকানগুলো তাদের ব্যবসা আরো লাভজনকভাবে পরিচালনা করতে পারবে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রসেসিং ইউনিটের মাধ্যমে জবাইকৃত মাংসে কোনো সালমোনেলা বা ইকোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এটি প্রমাণ করে যে, এই পদ্ধতিতে প্রস্তুত মাংস নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। এ কারণে, গবেষকরা স্থানীয় বাজারসমূহে ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত মাংস সরবরাহের তাগিদ দিয়েছেন।
অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে স্থানীয় বাজারের পোলট্রি দোকানগুলোর জন্য ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনে উৎসাহিত করতে হবে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পোলট্রি মুরগি বিক্রি বন্ধ করা জরুরি। এছাড়া, বাজার থেকে মাংস কেনার সময় ক্রেতাদের সতর্ক থাকতে হবে। ক্রেতা ও বিক্রেতাকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে জবাইকৃত মাংসের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।