'ক্ষমতা' না 'সত্য'-উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিতে কোনটির কদর অধিক? অমীমাংসিত এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় পল ক্রুগমনের একটি উক্তিতে। তিনি স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, 'কাহার নিকট সত্য আছে, তাহা গুরুত্বপূর্ণ নহে; বরং রাজনীতিতে বড় বিষয় হইল, কাহার হাতে ক্ষমতা রহিয়াছে।' অর্থাৎ, অধুনা বিশ্বের পাওয়ার পলিটিকসে ক্ষমতার নিকট যে সত্য বড্ড অসহায় হইয়া পড়িয়াছে, তাহাতে দ্বিমত নাই। কীভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হইল, তাহা ব্যাখ্যা করিতে গিয়া হেনরি অ্যাডামস বলিয়াছেন, 'বাস্তবে রাজনীতি অনেক তথ্য লুকাইয়া রাখে।' অ্যাডামস ভুল কিছু বলেন নাই! কারণ, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে দেখা যায়, সেইখানে যখন যাহারা ক্ষমতায় থাকেন, প্রায় সকলে সত্য গোপন করিয়া মিথ্যা ইতিহাস রচনা করেন। কেন এবং কীভাবে এই সংস্কৃতির গোড়াপত্তন ঘটিয়াছে, তাহা বুঝিতে একটি প্রচলিত কৌতুকের অবতারণা করা যাইতে পারে: এক বয়স্ক লোক এক তরুণের নিকট তাহার কর্ম বা পেশার কথা জিজ্ঞাসা করিলে ঐ যুবক 'সৎ রাজনীতি' করার চেষ্টা করিতেছে বলিয়া জানায়। বয়স্ক লোকটি নির্বিকারভাবে তাহার উদ্দেশে বলেন, 'ভালো। তুমি সত্যিই সাইন করিবে।' যুবক তখন জানিতে চাহেন 'তিনি কীভাবে তাহার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বলিয়া দিলেন?' বয়স্ক লোকটির উত্তর ছিল, 'কারণ, এই লাইনে সম্ভবত তোমার কোনো প্রতিযোগী নাই!'
কিন্তু সত্যি বলিতে, উন্নয়নশীল বিশ্বে এখনো সৎ রাজনীতি করিবার পরিবেশ গড়িয়া উঠে নাই। ইহার কারণ কী, তাহা খুঁজিতে ফিরিয়া তাকাইতে হইবে সেই বয়স্ক এবং যুবকের দিকে: সেই তরুণের সহিত বয়স্ক লোকটির কয়েক বৎসর পর আবার দেখা। যথারীতি তিনি যুবকটির 'সৎ রাজনীতি' কেমন চলিতেছে জানিতে চাহিলে যুবক জানান 'না, সৎ রাজনীতি সুবিধার নয়!' বয়স্ক লোকটি তরুলকে লইয়া বহুতল ভবনের ছাদে উঠিয়া যান এবং সেইখান হইতে নিচে লাফ দিতে বলেন এই বলিয়া যে, 'রাজনীতিতে গেইন করতে হইলে লাফ দাও।' যেই বলা সেই কাজ! সৎ রাজনীতি করিয়া উন্নতি করিতে চাওয়া তরুণ রাজনীতিবিদ লাফ দিয়া বসেন! ইহার পর যাহা হইবার তাহাই হয়-হাত-পা ভাঙিয়া টুকরা টুকরা হইয়া যায়। ঠিক সেই অবস্থায় বয়স্ক লোকটি তাহার কানে ফিসফিস করিয়া এই পরামর্শ দেন যে, 'নিজে সৎ থাকিবে; কিন্তু অন্য রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করিবে না: ইহাই তোমার রাজনীতির প্রথম এবং শেষ শিক্ষা।'
উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিতে না সৎরাজনীতির মূল্য থাকে, না থাকে রাজনীতিবিদদের মধ্যে ন্যূনতম পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বরং যখন যেই দল ক্ষমতার মসনদে বসে, তখন তাহাদের কথাই যেন শেষ কথা। আর সবচাইতে মারাত্মক যেই জিনিসটি চলে, উহা হইল রাজনীতিবিদদের 'চরিত্র হনন'। ফলে একটি সময়ে আসিয়া গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনই খাপছাড়া, ছন্নছাড়া হইয়া উঠে। এমনও দেখা যায়, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর একসময়কার বিতর্কিত নেতাদের পুনরুত্থান ঘটে, যাহাদের বিরুদ্ধেও একসময় হাজারো মামলা, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচারের অভিযোগ ছিল। এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, তাহাদের বিরুদ্ধে যেই সকল অভিযোগ বা মামলা ছিল, তাহার সকলই কি মিথ্যা, বানোয়াট? সেইখানে কি কোনো 'সত্য'ই আড়াল করা হয় না? আবার সকল অভিযোগই কি সত্য?
উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিতে 'রাজনীতি' হইল 'ব্যাধি' এবং 'রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা পরিবেশ' হইল 'স্বাস্থ্য'; অর্থাৎ, সেইখানকার রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরাইতে হইলে সকলের পূর্বে তালাশ করিয়া দেখিতে হইবে, সর্বাঙ্গে 'ব্যাধি' ছড়াইয়া পড়ে কেন, কী কারণে। বিজ্ঞজনরা বলিয়া থাকেন, যতক্ষণ না রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের প্রবণতা বন্ধ হইবে, রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হইবে, ততক্ষণ আর যাহাই হউক, 'নূতন দেশ' বিনির্মাণের পথ অবারিত হইবে না। উদারপন্থি গণতন্ত্রে রাজনীতিবিদদের সমালোচনা সাধুবাদযোগ্য; কিন্তু তাহাদের চরিত্রে কালিমা লেপন কাঙ্ক্ষিত নহে। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকিলে, তাহার বিচার হইতে হইবে, শাস্তি হইতে হইবে; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাহাদের চরিত্র হনন করা যাইবে না।