বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

'করো না সুখের আশ, পরো না দুখের ফাঁস' 

আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:০০

বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান বৎসর দুই পূর্বে বলিয়াছিলেন- 'শুধু টাকাই পারে মানুষের জীবনে প্রকৃত সুখ আনিতে।' কাহনেম্যান এই কথাটির ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছিলেন, সুখের অনেক নির্ধারক রহিয়াছে-তাহার মধ্যে একটি হইল অর্থ। আর সেই অর্থই সুখের একমাত্র গোপন চাবিকাঠি-যাহা মানুষের জীবনে সুখ বাড়াইতে সর্বাগ্রে সাহায্য করে।

শুধু কাহনেম্যান নহেন, মার্কিন লেখিকা গ্রেটচেন রুবিন তাহার 'দ্য হ্যাপিনেস প্রজেক্ট' গ্রন্থে লিখিয়াছেন-'অর্থ দিয়া সরাসরি সুখ কিনা যায় না বটে, তবে অর্থ ব্যয় করিয়া আপনি যে অসংখ্য জিনিস ক্রয় করেন কিংবা প্রয়োজনের সময় অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য রাখেন- তাহা আপনার ভালো থাকিবার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।' অন্যদিকে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক জো গ্লাডস্টোন বলিয়াছেন, 'ইতিপূর্বে সকল গবেষণায় সার্বিক সুখের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক খুবই কম বলিয়াই দেখা গিয়াছে। কিন্তু আমাদের গবেষণা তাহা ভুল প্রমাণ করিয়াছে। অর্থ থাকিলে মনের মতো যে কোনো পণ্য ও সেবা ক্রয় করা যায়। এই বস্তুগত চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মানসিক চাহিদা পূরণ হয় মন ও মেজাজ ভালো থাকে। শুধু তাহাই নহে-অর্থ আমাদের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করে। সার্বিকভাবে ভালো থাকিবার জন্য তো এই সকল কিছুই প্রয়োজন।' যুক্তরাজ্যের ৭৭ হাজার ব্যাংক লেনদেন পর্যালোচনা করিয়া জো প্লাডস্টোন তাহার গবেষণায় দেখিয়াছেন-অর্থের তাৎক্ষণিক সহজলভ্যতা জীবনে সন্তুষ্টি আনে।

কিন্তু জীবনের সন্তুষ্টি কি এতই সহজ? ইহা সত্য যে, অভাব যখন দরজায় আসিয়া দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়া পালাইয়া যায়। যদিও ইহার পালটা প্রবাদ রহিয়াছে-অর্থই সকল অনর্থের মূল। তবে পরিশ্রম, সংগ্রাম ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যাহারা জীবনভর অঢেল অর্থ উপার্জন করিয়াছেন-প্রয়োজনের সময় কি তাহার সেই উপার্জন সকল ক্ষেত্রে কাজে লাগে? সারা জীবন কষ্ট করিয়া আয়-উপার্জন ও সম্পদ তৈরির পর বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়-সেই অর্থ যেন জীবনসংসারের নিকট জিম্মি হইয়া যায়। এই চিত্র অধিক দেখা যায় আমাদের এই উপমহাদেশে। এই জন্য প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্বে কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) তাহার 'জীবন সংগীত' কবিতায় বলিয়াছেন-'বলো না কাতর স্বরে/ বৃথা জন্ম এ সংসারে/ এ জীবন নিশার স্বপন,/ দারা পুত্র পরিবার/ তুমি কার কে তোমার'। ইহার পর কবি সতর্ক করিয়া বলিয়াছেন-'করো না সুখের আশ,/ পরো না দুখের ফাঁস,/ জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়,/ সংসারে সংসারি সাজ,/ করো নিত্য নিজ কাজ,/ ভবের উন্নতি যাতে হয়।/ দিন যায় ক্ষণ যায়,/ সময় কাহারো নয়'।

হেমচন্দ্র উপমহাদেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করিয়া যাহা বলিয়াছেন-তাহা কি আজও সত্য নহে? যতক্ষণ একজন সফল ব্যক্তির হাতে রহিয়াছে অর্থ ও সম্পদের চাবিকাঠি, ততক্ষণ অবধিই যেন তাহার মূল্য। জ্ঞানীরা বলেন, সংসার একধরনের 'রিলে রেসের মতো'- সবচাইতে যোগ্য ব্যক্তিকেই 'ব্যাটন হাতে' সবচাইতে বেশি দৌড়াতে হয়। কিন্তু যতক্ষণ ব্যাটন হাতে থাকিবে-ততক্ষণই কি কেবল মূল্য? প্রবল শ্রমসহযোগে অক্লান্ত চেষ্টায় তিনি যে পুরা দলকে সবচাইতে বেশি আগাইয়া দিলেন-ইহার পর তাহার হাত হইতে যখন 'ব্যাটন' অন্যের হাতে চলিয়া গেল-তখন কি তাহার ভালোমন্দ-ইচ্ছা-স্বাধীনতা-সকল কিছু মূল্যহীন হইয়া গেল? এই ক্ষেত্রে স্মরণ করিতে হয় মহামতি চাণক্যের শ্লোক। তিনি বলিয়াছিলেন: 'পুস্তকস্থা তু যা বিদ্যা পরহস্তগতং ধনং।/কার্য্যকালে সমুৎপন্নে ন সা বিদ্যা ন তদ্ধনং।' সহজ বাংলায়- 'বিদ্যা কেবল পুথিগত হইলে এবং অর্থ অন্যের নিকট গচ্ছিত থাকিলে, সেই বিদ্যা এবং অর্থ প্রয়োজনের সময় কাজে লাগে না।'

এমতাবস্থায় আমাদের আবার ফিরিয়া আসিতে হইবে হেমচন্দ্রের কথায়। তিনি একাংশে বলিয়াছে: 'ওহে জীব অন্ধকারে,/ ভবিষ্যতে করো না নির্ভর:/অতীত সুখের দিন, পুনঃ আর ডেকে এনে,/ চিন্তা করে হইও না কাতর।' আর শেষ কথা হইল-মহান আল্লাহ যাহার কিসমতে যাহা লিখিয়া দিয়াছেন, তাহাই হইবে। সুতরাং অধিক চিন্তা করিয়া কাতর হইয়া কী হইবে?

ইত্তেফাক/এএম