ভারতের গুজরাটে বাংলাদেশি নাগরিক সন্দেহে গত শনিবার (২৬ এপ্রিল) ভোর রাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে তারা আটক করেছে বলেছে দেশটির পুলিশ। তবে নিশ্চিতভাবে ৪৫০ জন বাংলাদেশিকে তারা চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন রাজ্যটির পুলিশের মহা-নির্দেশক বিকাশ সহায়। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট ইন্ডিয়া (পিটিআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
মহা-নির্দেশক বিকাশ সহায় জানান, ‘নথির ভিত্তিতে এখনও পর্যন্ত এটা নিশ্চিত করা গেছে যে ৪৫০ জন বাংলাদেশি নাগরিক বেআইনিভাবে এখানে থাকছিলেন। আটক হওয়া বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমাদের মনে হচ্ছে, একটা বড় সংখ্যায় বেআইনি বাংলাদেশিদের পরিচয় আমরা নিশ্চিত করতে পারবো।’
গত শনিবার রাত তিনটায় সুরাট থেকে আটক করে সুলতান মল্লিক ও তার দুই ভাগ্নেকে। প্রায় তিন দিন পার হলেও তারা মুক্তি পায়নি। বাংলাদেশি সন্দেহেই আটক হওয়া মল্লিকের পাসপোর্ট ও ১৯৯৩ সালের একটি জমির দলিলে দেখা যায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর অঞ্চলের বাসিন্দা। সুলতান মল্লিক গত ছয় বছর ধরে সুরাটে এমব্রয়ডারির কাজ করেন।
সুরাট থেকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক হওয়া সুলতান মল্লিকের স্ত্রী সাহিনা বিবি জানান, প্রথমে তো জানতেই পারিনি কোন থানায় নিয়ে গেছে, কোথায় রেখেছে আমার স্বামীকে। শনিবার আমার স্বামী পুলিশের একটা নম্বর থেকেই ফোন করে জানায়, তাদের কোনও একটা গুদাম ঘরে রেখেছে। সব নথি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বলেন। পরে পাসপোর্ট, জমির দলিল- যা যা প্রমাণ ছিল, সব পাঠিয়েছি। কিন্তু তারপর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত আর কোনও যোগাযোগ নেই। এদিকে আমার শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তার ছেলের এই দশা দেখে; আমার বড় মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। মাত্র একবছর হলো আমি গুজরাতে এসেছি- এখন কোথায় স্বামীর খোঁজ করতে যাবো বুঝতে পারছি না।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ গুজরাতের ধরপাকড় শুরু হওয়ার পরে একটি হেল্পলাইন খুলেছে। প্রিয়জনের খোঁজ পাওয়ার জন্য ওই হেল্প লাইনে গত দুদিনে প্রিয়জনের খোঁজ না পাওয়া একশোরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানাচ্ছিলেন সংগঠনটির রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক।
তিনি জানান, গুজরাটে সংখ্যাটা বড়, তাই বিষয়টা ব্যাপক আলোচনায় উঠে এসেছে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা আর মহারাষ্ট্রেও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে হেনস্থা করার ঘটনা সম্প্রতি খুব বেড়ে গেছে। এরকম পরিস্থিতি হতে যাচ্ছে এই আশঙ্কা করেই আমরা গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে একটা চিঠিও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কাজ যে কিছু হয়নি, দেখাই যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, একটা গুরুতর বিষয় জানতে পারলাম মল্লিকের ব্যাপারে। আটক হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আদালতে পেশ করার কথা। কিন্তু তিনদিন হয়ে গেল তাদের আটক করা হয়েছে, তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি।
আহমেদাবাদ পুলিশের ‘ক্রাইম ব্রাঞ্চ’ দপ্তরের সামনে বিবিসি গুজরাটের সংবাদদাতা তেজশ ভৈদের সঙ্গে কথা হয় ফারজানা নামে এক নারীর সঙ্গে। ফারজানা জানান, ‘বাড়িতে বিয়ে ছিলো। বরযাত্রীরা এসেছিল। আমাদের বাড়ি খুবই ছোট, তাই তাদের ঘুমোনোর ব্যবস্থা করেছিলাম চান্দোলা এলাকায় এক আত্মীয়র বাড়িতে। সেখান থেকেই বাংলাদেশি সন্দেহ করে বরযাত্রীদের ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।’
তিনি জানান, মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে এসেছিল আমার বড় ভাই আর ভাতিজা। তারা না থাকলে কী করে বিয়ে হবে! ওইদিনই বাড়িতে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান ছিল। সেটাও পিছিয়ে দিতে হয়েছে। তাদের বিয়েতেই সপরিবারে এসেছিলেন আমার আত্মীয় জেবুন্নেসা নামক এক নারী। তার ছেলে আর ভগ্নীপতিকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে। পরে সব নথিপত্র জমা দেওয়ার পরে শনিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে সবাইকে ছাড়া হয়।
ফারজানা আরও জানান, আমার আত্মীয়রা কেউ বাংলাদেশি নন, এমনকি বাংলাভাষীও নন। তারা গুজরাট আর মহারাষ্ট্রের মুসলমান।
ক্রাইম ব্রাঞ্চের দপ্তর সামনে আহমেদাবাদের বাসিন্দা আলমআরা পাঠান নামে আরও এক নারী জানান, আমি তো সৈয়দবাড়ি মোহাম্মদী মসজিদ এলাকায় থাকি। গত ২৩ বছর ধরেই আহমেদাবাদে আছি। আমার ছেলে রিয়াজের শ্বশুরবাড়ি চান্দোলা ঝিল এলাকায়। রাতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল সে, সেখান থেকে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আমার পুত্রবধুকেও আটক করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর বিভাগের প্যান কার্ড, বিদ্যুতের বিল– সব নথিই আছে। পুলিশ আমাকে জানায় যে সব নথি নিয়ে যেন এখানে হাজির হলে ছেলে আর ওর বউকে ছেড়ে দেবে। পরে শনিবার রাত দশটায় তার ছেলে ও পুত্রবধুকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে আবারও তাদের দেখা করতে বলা হয়েছে।
আলমআরা পাঠান বলেন, আমরা তো বাংলাদেশ থেকে আসিনি, অপরাধও করিনি। আমার সন্তানরা এখানেই জন্মিয়েছে। তবুও বুঝতে পারছি না ছেলে আর তার স্ত্রীকে কেন আটক করা হলো।
গুজরাতেই ভারুচে থেকে আটক হয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার সাঁকরাইলের বাসিন্দা নূর শেখ। তিনি কাপড় কারখানায় কাজ করেন। গত সোমবার কাজ করার পরে বিকালে চা খেতে বাহিরে যান তিনি। সেখান থেকে আটক হন নূর শেখ।
তিনি আরও জানান, ‘কাজের পরে বিকালে চা খেতে যাচ্ছিলাম বড় রাস্তায়। সেদিকে যেতেই এক বন্ধু বলল একটু আগে হাওড়ারই এক বাসিন্দাকে দোকানের সামনে থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। আমি তখনও গলির ভেতরেই ছিলাম। বাংলাদেশিদের ধরবে ধরুক। কিন্তু আমরা তো ভারতীয়। দরকার হলে আধার চেক করে দেখুক। অন্য সব নথিও আছে। কিন্তু ধরে নিয়ে গিয়ে এরকম হেনস্থা করার কী মানে?
‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক জানান, নূর শেখ যে অঞ্চলে থাকেন, সেই ভারুচ জেলার কোটকপুর এলাকায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও হাওড়া জেলার প্রায় এক হাজার জনের বেশি শ্রমিক আছে। গুজরাট পুলিশ এসে এই শ্রমিকদের ডকুমেন্ট চেক করে গেছে।
তিনি আরও জানান, গুজরাত পুলিশের সন্দেহ আধার কার্ড বা ভোটার পরিচয়পত্রসহ নথি বাংলাদেশিরাও বানিয়ে নিতে পারে। তাই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়সহ বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া কয়েকটি রাজ্য গুজরাট পুলিশ তাদের দল পাঠাচ্ছে। যেসব পরিচয়পত্র জমা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আসল না কি নকল, সেটা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে গুজরাট পুলিশ।