শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

গৃহকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার শেষ কোথায়-২

পদে পদে নিরাপত্তাহীন গৃহকর্মীরা

৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী নির্যাতনের পর কারো কাছে অভিযোগ করেন না : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস

আপডেট : ২৯ জুন ২০২৫, ০৬:০০

জান্নাতুল ফেরদৌসী ছোটবেলা থেকেই গৃহশ্রমিকের কাজ করে। আগে দিন-রাত থেকে করত। এখন ঘণ্টা হিসেবে। জান্নাত বলেন, ছোটবেলায় কাজ করার সময় এক রকম নির্যাতন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর এক রকম নির্যাতন শুরু হয়। ভালোমন্দ যা-ই রান্না হোক, গৃহকর্তী আমাদের সব সময় বাসি খেতে দেয়। বাচ্চারা খেতে না পারলে, ফেলে দিলেই আমাদের ভালো খাবার জোটে। একটা গ্লাস কিংবা কোনো কিছু ক্ষতি করলে আমার বেতন থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়। ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত অনেকবারই গৃহকর্তা, তাদের ছেলে, কিংবা বাড়িতে বেড়াতে আসা কোনো কোনো আত্মীয় আমাকে টাকার বিনিময়ে খারাপ প্রস্তাব দেয়। আমি একদিন গৃহকর্ত্রীকে এ কথা জানাই। উনি সেজন্য উলটো আমাকেই দোষ দিয়ে কাজ থেকে বিদায় করে দেন। 

গৃহকর্মী জাতীয় ফোরামের সভাপতি জাকিয়া সুলতানা বলেন, অবস্থার এখনো পরিবর্তন হয়নি, তাদের নিবন্ধিত ১৬ হাজার গৃহকর্মী আছে। প্রতিনিয়তই তাদের কাছে এমন অভিযোগগুলো আসে। ধর্ষণ, ধর্ষণ করে হত্যা, নির্যাতন করে হত্যা, হত্যার পর আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলে।

গৃহকর্মী ও নেতারা যা বলেন

১৫ বছর বয়সি প্রীতি উড়ানকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেন জাকিয়া সুলতানা এবং গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী আবুল হোসেন। আবুল হোসেন বলেন, প্রীতি উড়ানকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কল্যাণপুরের গৃহশ্রমিক লিজা আক্তার বলেন, কল্যাণপুরের ৯ নম্বর বস্তির ১৪ বছর বয়সি এক গৃহশ্রমিক ১০ নম্বরের এক বহুতল ভবনে কাজ করতে গিয়ে গর্ভবতী হয়। মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল। আমরা বস্তির কয়েক জন মিলে তাদের কাছে গেলে, প্রথমে তারা অস্বীকার করে। মামলা করা হলে, ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। কিন্তু না দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গৃহকর্মীদের ৯০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায়। ১০ শতাংশ ধর্ষণের শিকার হয়। 'অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট' (এএসডি) পরিচালিত 'সিচুয়েশন অব চাইল্ড ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইন ঢাকা সিটি' শীর্ষক জরিপ

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে করা হয়, যা চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। এই জরিপমতে আইনের সহায়তা নেয় না গৃহশ্রমিক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস-বিলস-এর গবেষণা বলে ৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী নির্যাতনের পর কারো কাছে অভিযোগ করে না। তাদের কাছে এগুলো 'নিয়মিত ঘটনা'। আইন ও শালিশ কেন্দ্রের (আসক) অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড নেটওয়ার্কিংয়ের সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, আসক গৃহশ্রমিকদের পক্ষে বেশ কয়েকটা মামলা করে। এখন পর্যন্ত গৃহশ্রমিকের কোনো মামলায় শাস্তি কার্যকর হয়নি। আলোচনাকালে একটি মাত্র মামলায় বিচারের উদাহরণ আসে-২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে নির্যাতন করে ঢাকার পল্লবীর ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। অপরাধটি প্রমাণিত হলে ঘটনার চার বছর পর ২০১৭ সালে ১৮ জুলাই দোষী নওরীন জাহানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করে আদালত। পরে অবশ্য এই মামলার ক্ষেত্রেও আপসের কথা জানাজানি হয়।

ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) আসে ৭ শতাংশ মামলা

ওসিসি-ঢাকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিনকি বলেন, গৃহশ্রমিক নির্যাতনের চেয়ে ধর্ষণের মামলা তারা বেশি পান। চলতি বছর সাতটি গৃহশ্রমিক ধর্ষণের মামলা তারা পেয়েছেন। নারী ও শিশু নির্যাতনের মোট মামলার ৫-৬ শতাংশ গৃহশ্রমিক ধর্ষণের মামলা হয়। কিন্তু দুটি কারণে তারা মামলাগুলোর বিচার পর্যন্ত যেতে পারেন না: প্রথমত কোর্টের বাইরে আপস, দ্বিতীয়ত নির্যাতনের শিকার মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেলে তারা আর এ বিষয়ে কথা বলতে চায় না।

ছয় বছর ধরে চলছে মারুফা হত্যা মামলা ২০২০ সালের মে মাসে নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার চরসিংধা গ্রামে তারিখ কাঞ্চন চেয়ারম্যানের বাড়িতে ১৪ বছর বয়সি গৃহকর্মী মারুফা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। মেয়েটি তার মাকে চেয়ারম্যান তাকে যৌনহয়রানি করে বলে জানিয়েছিল। জানায় চেয়ারম্যানের স্ত্রীকেও। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মেয়েটিকে হত্যার পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে প্রচার করা

হয়। পুলিশও আত্মহত্যার তথ্য দেয়। ফলে নিম্ন আদালতে মামলাটি ডিসমিস হয়ে যায়। পরে মামলাটি হাইকোর্টে আসে, যা বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় আছে। মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আতাউল্লাহ নুরুল কবীর বলেন, "ময়নাতদন্তে মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই তার মা আপিল করে। আমরা মামলাটির পূর্ণ তদন্তের আবেদন করেছি। মামলাটির সঙ্গে আছে 'আমরাই পারি পারিবারিক জোট'।” জোটের নির্বাহী পরিচালক জিনাত আরা হক বলেন, 'এত কম বয়সে গৃহশ্রমিকরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আমরা শ্রম আইনে বলছি, শিশুর বয়স ১৪ বছর; বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনে বলছি ১৬ বছর, আবার শিশু আইনে বলছি ১৮ বছর শিশুর বয়স। এর সুরাহা প্রযোজন।'

নীতি পারছে না সুরক্ষা দিতে

বাংলাদেশে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা নীতিমালা করা হয় ২০১৫ সালে। নীতিমালায় আছে গৃহশ্রমিকদের ন্যায্য বেতন, কর্ম পরিবেশ, কর্মঘণ্টা, বয়স, নিয়োগপত্র, নিবন্ধন থাকবে। এটির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি মনিটরিং সেল থাকবে। এই নীতির বাস্তবায়ন এবং নীতির ব্যত্যয় ঘটলে সেই সেলের পরিদর্শন করার কথাও আছে। পরিদর্শন দল গৃহকর্মীকে নির্যাতনের বা অমানবিক আচরণের বিষয়ে মনিটরিং সেল অথবা ডিসি বা ইউএনও কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানাবে। কিন্তু এসব কিছুই হচ্ছে না।'-এ কথাগুলো বলেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস নিবাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। তিনি বলেন, নীতিমালার সুফল ভুক্তভোগীরা পায় না। তাই তারা এ সম্পর্কে জানেও না। সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রম আইনে গৃহশ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করা খুব জরুরি কিন্তু ঘরে ঘরে কীভাবে তদন্ত হবে, এটি ভেবে সংশ্লিষ্টরা শ্রম আইনে এটি অন্তর্ভুক্ত করছে না। তিনি বলেন গৃহশ্রমিকের নিবন্ধন ব্যবস্থা করতে হবে। একজন শ্রমিক কোনো বাসায় কাজ করছে কিন্তু কেউ তা জানে না, তাই তার দায়ও কেউ নেয় না। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের গৃহশ্রমিকদের একটি নিবন্ধন কার্যক্রম থাকা জরুরি।

ইত্তেফাক/এমএএম