বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনা তাণ্ডব: উচ্চশিক্ষার সংকট

আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২১, ০৬:২২

করোনার এক বছর পূর্তি হয়ে গেছে। ২০২১ সালের মার্চ মাস আমরা অতিক্রম করেছি। ২০২১ সালের মার্চ মাসের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ একটু আত্মতৃপ্তি অনুভব করছিল এ কথা ভেবে যে, প্রতিবেশী ভারত এবং পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুহার কম। 

২০২১ সালের শুরুতে মনে হয়েছিল বাংলাদেশ দু-এক মাসের মধ্যে করোনামুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সে আশা এখন দুরাশায় রূপান্তরিত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে মৃত্যুহার প্রতিদিনে পাঁচ-সাত জনে নেমে এসেছিল, বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৪০/৫০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটছে। আক্রান্তের হারও ফেব্রুয়ারি (২০২১) মাসের তুলনায় পাঁচ-ছয় গুণ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে দেশে করোনা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাধ্য হয়ে ০৫/০৪/২০২১ তারিখ থেকে সমগ্র দেশ লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে।

আমরা সবাই জানি, জীবন ও জীবিকা একে অপরের পরিপূরক। তবে এ কথাও ঠিক জীবনের জন্যই জীবিকা। জীবন রক্ষা করাই এখন বড় কাজ। লকডাউন যদি জীবনকে রক্ষা করতে পারে, সে পথেই মানুষকে হাঁটতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পারলে হয়তো লকডাউনের প্রয়োজন হতো না, কিন্তু কে শোনে কার কথা।

করোনার তাণ্ডবের ফলে সমাজের মানুষ যে আজ খানিকটা দিশাহারা হয়ে উঠেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণস্বরূপ আমি দেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে কিছু আলোকপাত করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের তালা ভেঙে হল দখল করার চিত্রও আমরা প্রচারমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়। 

০২/০৪/২০২১ তারিখে দেশ জুড়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এটি নিয়েও এখন সরকারের সমালোচনা চলছে। ভর্তি পরীক্ষা না নিলেও সমালোচনা, আবার ভর্তি পরীক্ষা নিতে গেলেও সমালোচনা, সরকার এখন যাবে কোন পথে? তবে এ কথাও ঠিক হাজার হাজার পরীক্ষার্থীকে একসঙ্গে ডেকে নিয়ে এসে স্বাস্থ্যবিধিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পরীক্ষা নেওয়ার কাজটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। 

আমার এক নাতনি জাপানের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে জাপানে যেতে হয়নি। ঢাকা থেকেই অনলাইনে জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পেরেছে। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। অনলাইনে তার ভর্তি প্রক্রিয়াও শেষ হয়ে গেছে। শুনলাম, অনলাইনে তাদের ক্লাসও শুরু হয়ে যাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। আমার অপর এক নাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাকে দেখছি অনলাইনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাস করছে, কিন্তু পরীক্ষা হচ্ছে না। 

পরীক্ষা না নেওয়ায় তাদের পঠনপাঠনে খানিকটা স্থবিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কোর্স শেষ হয়ে গেছে, পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। পরবর্তী সেমিস্টারে প্রমোশন না দিতে পারলে পঠনপাঠন তাদের বন্ধ হয়ে যাবে। করোনাকাল ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠছে। কাজেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে অতি দ্রুত নতুন করে কিছু সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকেই অনুমান করা যায় বিশ্বমানের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা যেখানে আছে, সেটাই বিশ্ববিদ্যালয়। কাজেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে। তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মান হারাবে। সেটি কখনো কাম্য নয়।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবিচ্ছিন্ন। শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়াই আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারব, এমনটি ভাবা সমীচীন হবে না। আমাদের দেশ আর্থসামাজিকভাবে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে, এটি জাতির জন্য একটি সুসংবাদ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মধ্যমমানের শিক্ষাব্যবস্থা যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, সেক্ষেত্রে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্থায়ী আসন পাবে না। সে বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে আমাদেরকে আরো সতর্ক হতে হবে। যত দূর খবর পাওয়া যাচ্ছে, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শুধু অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, অনলাইনে তারা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাও নেওয়ার ব্যবস্থা করছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদেরকেও ভাবতে হবে।

অনলাইনে ক্লাস যদি নেওয়া যায়, পরীক্ষা নেওয়ারও একটা ব্যবস্থা বের করতে হবে। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় বলে একটি প্রবাদ বাক্য আছে। করোনাসৃষ্ট সংকট মোকাবিলা করতে হলে আমাদেরকে হাত গুটিয়ে বসে থাকবার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয় তাদের জ্ঞান পরিমাপের জন্য। অনলাইনে প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান পরিমাপ করা যাবে না, এমনটি হতে পারে না। 

থিওরেটিক্যাল পরীক্ষায় কোনো রকম সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব পাঠ্য বিষয় আছে, তাদের সিলেবাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ৮০ শতাংশ পরীক্ষা হবে থিওরি বিষয়ে ২০ শতাংশ পরীক্ষা হবে ব্যাবহারিক। ২০ শতাংশ ব্যাবহারিক পরীক্ষার জন্য ৮০ শতাংশ থিওরি পরীক্ষা স্থগিত করে রাখা মোটেই সমীচীন হবে না। ২০ শতাংশ ব্যাবহারিক পরীক্ষার দায়ভার সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর হাতে ছেড়ে দিলেই সমস্যার সমাধান সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো অনায়াসে দিতে পারবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে এসে ব্যাবহারিক এবং তত্ত্বীয় বিষয়গুলোর পরীক্ষা নিয়ে নিতে পারবে। কেউ বুঝতেই পারবে না কোথায় কীভাবে কারা পরীক্ষা নিচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে করোনার তাণ্ডব দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা পাশাপাশি চলছিল। সেখানে কোনো সমস্যা ছিল না। তবে শোনা যাচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে একটা বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা চলছে। এটি করতে গেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হবে। পরীক্ষা নিতে না পারলে শিক্ষার্থীদের প্রমোশন আটকে যাবে, প্রমোশন আটকে গেলে শিক্ষার্থীরা তাদের সেমিস্টার ফি দেবে না, এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে গেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। 

কাজেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার পথ বন্ধ করার বিষয়টি হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা এক রকম নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে সরকারের টাকায়, অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে শিক্ষার্থীদের টাকায়। শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা এবং প্রমোশন ব্যবস্থা না থাকলে শিক্ষার্থীরা সেমিস্টার ফি দেবে কেন? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করবার আগেই ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বড় রকমের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। নতুনভাবে করোনার যে তাণ্ডব শুরু হয়েছে, তাতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশাসক অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ প্রশাসক বলতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেই বলতে চাইছি। আমার জানামতে, ২০২১ সালে সরকারি তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যের ১৫/২০টি পদ শূন্য হবে। এই শূন্যপদগুলো পূরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য পদ পূরণের ক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে, আমি তা মনে করি না। 

একজন উপাচার্যের জন্য কয়েকটি গুণ অপরিহার্য, যেমন—পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিজ নিজ বিষয়ে পাণ্ডিত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই প্রফেসর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন, সে অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রফেসরই পণ্ডিতজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্ব প্রমাণের দুটো উপযুক্ত স্থান—শিক্ষক সমিতির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন এবং অনুষদ অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন। বিশেষ করে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়, ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বের গুণাবলি ছাড়া কেউ অনুষদ অধিকর্তা এবং শিক্ষক সমিতির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে পারেন না। সে বিচারে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা প্রাধান্য পেতেই পারেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে দ্বিতীয় বারের জন্য উপাচার্য না করাই ভালো। এতে জটিলতার সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে দ্বিতীয় বার উপাচার্য দায়িত্ব পালন শেষে তারা সম্মানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব শেষ করতে পারেননি। উপাচার্য হওয়ার মতো দেশে যোগ্য শিক্ষকের যেখানে অভাব নেই, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে অযথা জটিলতা সৃষ্টি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন