শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আফগানিস্তানে নারী ও শিশুদের চরম মূল্য দিতে হবে

আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২১, ০৯:১৯

আফগানিস্তানের শহর তালেবানের দখলে যাওয়ার পর আমার ভেতরে একটা বিশেষ অনুভূতি হয়। এই অনুভূতিকে ফরাসিতে বলা ‘ডেজা ভু’। ‘ডেজা ভু’ হলো মানুষের স্মৃতির এমন একটি চরম প্রতিক্রিয়া, যা মানুষকে এই অনুভূতি দেয় যে, সে বিষয়টি ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে।

আমারও মনে হয়েছে আফগানিস্তানের শহর দখলের ঘটনা আমিও ইতিপূর্বে দেখেছি। টাইম মেশিনে করে আমার মন চলে যায় ১৯৯৬ সালে। আমি দেখতে পাচ্ছি, কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি কালাশনিকভ হাতে নিয়ে কাবুলের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রকাশ্য দিবালোকে নীল বোরকা পরিহিত নারীদের বেত্রাঘাত ও মারধর করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে আমি বাংলাদেশে ছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।

আমার মনে আছে, সেই সময় কাবুল দখলের সঙ্গে সঙ্গেই তালেবানরা আফগান নারী ডাক্তার ও প্রকৌশলীদের কর্মস্থলে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। একটি আধুনিক জনজীবনের সব অধিকার থেকে নারী ও মেয়েদের নির্মমভাবে ‘শূন্য’ করে দেওয়া হয়েছিল। আর যেসব নারী এর পরও সাহস করে বাড়ির বাইরে পা রেখেছিল, তালেবানরা তাদের ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করতে দ্বিধা করেনি। এবং যেসব নারী তাদের পুরুষ অভিভাবকদের সঙ্গে রাখতে চায়নি, তাদের নৃশংসভাবে চাবকিয়েছিল পুলিশ কর্মকর্তারা। সেই সময়ের কথা ভাবলে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে এখনো শীতল স্রোত বয়ে যায়।

আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে এসব ঘটনা। আর এটা ভেবে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি যে, আফগানিস্তানে যা ঘটছে তা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। আরো আতঙ্কের ব্যাপার হলো, আমরা সে সময় লক্ষ করেছি, তালেবানের দখলের কিছুদিন পরই মধ্য এশিয়ার ঐ জাতিকে ভুলে যায় বাকি বিশ্ব। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত যতক্ষণ না আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে আমেরিকা তালেবানকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে, তার আগে আমরা তালেবান সম্পর্কে আর কিছুই শুনিনি।

আফগান আক্রমণের জন্য নয়-এগারোর ঘটনা একটি ‘সরকারি’ কারণ ছিল নিশ্চিত। তবে এটাও বড় বাস্তবতা ছিল যে, আফগান নারীদের দুর্দশা থেকে উদ্ধার করার বিষয়টি আমেরিকান জনসাধারণের মন জয় করার জন্য মার্কিন সরকার তখন কাজে লাগায়।

পাঠকের মনে হতে পারে, আমি এতটা নিশ্চিত হলাম কী করে? ২০০০-এর দশকে আর্লিংটন-ভিত্তিক রাজনৈতিক অ্যাকশন গ্রুপ, ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশনের নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনীত ক্যাম্পেইন আফগান নারী ও মেয়েদের জন্য আফগান প্রকল্পের আমি সংগঠক ছিলাম।

২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার পর ফার্স্ট লেডি লরা বুশ বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইও নারীর অধিকার এবং মর্যাদার জন্য একটি লড়াই।’ তিনি এজন্য আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপের জন্য প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, (আফগান) নারীরা ‘আর তাদের ঘরে বন্দি ছিলেন না।’

আজ আমি আমেরিকার ফার্স্ট লেডির সেই মন্তব্যের কথা ফিরে ফিরে ভাবছি আর আমার ভেতরটা ক্রোধে ভরে উঠছে। আজ কাবুল বিমানবন্দরে আফগানদের টারম্যাক ধরে একটি আমেরিকান বিমানের পেছনে মরণপণ ছুটে যাওয়ার এবং পিষ্ট হওয়ার দৃশ্য দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। আজ যখন আফগান নারীরা তাদের দেশের রাস্তা থেকে অদৃশ্য হতে শুরু করেছে, তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি আতঙ্কে জমে যাচ্ছি।

ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশন (এফএমএফ) থেকে একটি চিঠি প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে পাঠানো হয়েছে, যার একটি লাইনে বলা হয়েছে, ‘আফগানিস্তান থেকে তালেবানের আগ্রাসন সম্পর্কে বেরিয়ে আসা বিধ্বংসী সংবাদে আমরা মর্মাহত এবং আপনার প্রশাসনকে আফগান নারী ও মেয়েদের সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এবং এই মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য আমরা আপনাদের অনুরোধ করছি।’ এই চিঠি গ্লোরিয়া স্টেইনামসহ ৮৫ জন নারী ও মানবাধিকারকর্মীদের সহস্বাক্ষরিত। আফগানিস্তানে তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর যাদের জীবন এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেসব নারী ও মেয়ের সুরক্ষায় দ্রুত কাজ করার জন্য ঐ চিঠিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে অনুরোধ জানানো হয়।

চিঠিটি এরপর বাইডেন প্রশাসনকে এই বলে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ‘আমরা আপনার প্রশাসনকে অনুরোধ করছি, তারা যেন তালেবান শাসনের স্বীকৃতি ও সমর্থনসহ কোনো চুক্তিতে রাজি না হয়।’ চিঠিতে আরো বলা হয় যে, তালেবানদের মাধ্যমে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছিল, বিশেষ করে আফগান নারী ও শিশুদের, সেটার স্বীকৃতি দিতে ইতিপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ টালবাহানা করেছিল।’

আফগান নারী ও মেয়েদের অধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যারা নিঃস্বার্থভাবে এবং সাহসিকতার সঙ্গে বিপুল ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, চিঠিতে সেসব মানবাধিকার নেতার জীবন বাঁচানোর জন্য এবং আফগান নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার সরকারকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। চিঠিতে আরো দাবি করা হয়েছে, এদের জন্য অবিলম্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

আসুন, আমরা বাস্তববাদী হই। আফগানিস্তান থেকে ২০ বছর পর আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার তালেবানি আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে বের হওয়ার উপায় নয়। আফগান নারী ও মেয়েদের অগ্রগতি ঘটা সত্ত্বেও, জাতিসংঘ থেকে গত মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মে ও জুনে নারী ও শিশুদের হত্যা এবং আহত হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে, ঠিক এই সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সৈন্যরা আফগানিস্তান থেকে তাদের অবশিষ্ট সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করেছিল।

এটা আমাকে সত্যিই বিরক্ত করেছে যে, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি আফগান নারীদের মুক্ত করা থেকে পালটে গিয়ে পরিণত হলো কত দ্রুত কেবল আমেরিকানদের ঐ নারকীয় দেশ থেকে বের করে আনা যায়! কিন্তু আমি হয়তো এক সেকেন্ডের জন্যও বিশ্বাস করতে পারিনি যে, আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধটি ছিল আমেরিকানদের স্বার্থ ছাড়া, অন্য কিছু নিয়ে। আমরা এত দিন শুধু সে দেশের নারীর ও মেয়েদের মৌখিক আশ্বাস দিয়েছি, কিন্তু তাদের জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।

যেহেতু আফগানিস্তান থেকে ভয়াবহ খবরের স্রোত অব্যাহত রয়েছে, আমি সেই দেশে নারী ও শিশুদের হত্যার আশঙ্কা করছি, যা বেশির ভাগ আমেরিকান তাদের বসার ঘরে আরাম সোফায় বসে দেখবে। আমি আরো আশঙ্কা করছি যে, এভাবে আফগান নারী ও মেয়েরা তাদের জীবনের সর্বোচ্চ মূল্য চুকাবে। এরকমটি যখন ঘটবে, তখন আমরা আমাদের মেয়েদের কাছে কী করে মুখ দেখাব?

আর সবাই এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে চায় যে, আফগানিস্তানে যা ঘটছে তা এত দূরে যে, এটি আমাদের কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না। কিন্তু এটা সত্য নয়। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি নারীবাদী নীতি-বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে কাজ করছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি একটি সত্য উপলব্ধি করেছি—তা হলো, নারীর অধিকার সারা বিশ্বের সঙ্গে জড়িত।

বিখ্যাত আমেরিকান নাগরিক অধিকারের নেতা ফ্যানি লু হ্যামারের কথার সঙ্গে প্রতিধ্বনি করে আমিও বলতে চাই—আমরা সবাই মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই আসলে স্বাধীন নই। এই কথাগুলো এখনকার চেয়ে আর কখনো বেশি সত্য ছিল না।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক, নারী অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন