শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশেষজ্ঞমত

করোনা ভাইরাস মহামারী ও সংক্রামক ব্যাধি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অবস্থান

আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২০, ২২:২৭

একটি সংক্রামক রোগ সারা পৃথিবীকে কেমন অবশ করে দিতে পারে তা করোনাভাইরাস  আবারো নতুন করে দেখিয়ে দিলো। একটা সময় ছিল যখন সংক্রামক রোগ ছিল জীবন সংহারী। সেসময়ে সংক্রামক রোগ ছিল আজকের ক্যান্সার এর মতো। ছিল বুবনিক প্লেগ, সিফিলিস, কলেরা, ম্যালেরিয়া আর যক্ষ্মার মতো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব, যার প্রভাবে নিশ্চিহ্ন হয়েছে সভ্যতা, কোটি মানুষের জীবন। স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর আবিষ্কার প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক ‘পেনিসিলিন‘ বদলে দিলো পৃথিবী, বদলে দিলো চিকিৎসা শাস্ত্র। এন্টিবায়োটিক নামে এক ‘মিরাকাল ড্রাগ’মানুষের মন থেকে কাটিয়ে দিলো সংক্রামক ব্যাধিজনিত সব ভয় আশঙ্কা।  অথচ একথা হয়তো অনেকের অজানা যে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে সংক্রামক ব্যাধি এখনো সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারন। একথা হয়তো অনেকেরই অজানা যে, অনেক এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহারে।

যে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যত বেশি উন্নত, যত বেশি সার্বজনীন, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে সে দেশ তত বেশি সফল। কিন্তু তার পরেও দেখা যাচ্ছে, কোভিড১৯ এর মত একটি নতুন ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে সেসব দেশকেও কতখানি বেগ পেতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে এ মহামারী মোকাবেলা করতে যেসব চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হতে হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। সম্ভবত সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বাংলাদেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যেখানে সংক্রামক ব্যাধি ব্যবস্থাপনা ব্যাপারটিই চরমভাবে উপেক্ষিত। বাংলাদেশে সংক্রামক ব্যাধি ব্যবস্থাপনায় কোনো আদর্শ নিয়ম বা আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনে চলা হয় না। এখানে অনেক চিকিৎসক রোগের কারণ না খুঁজেই, শুধু উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দেন। সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই বললেই চলে। সারাদেশে সংক্রামক ব্যাধি শনাক্তকরণে ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটি নেই বললেই চলে।  এমনকি দেশের সর্বোচ্চ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইনফেকশাস ডিজিজ ডিপার্টমেন্টও নেই! কাজেই একথা পরিষ্কার যে এদেশে এখনো মানুষ বেঁচে আছে তাদের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাবলে। এই দেশে একথা অজানাই থেকে যাবে কতজন মানুষ জীবন হারিয়েছে ভুল চিকিৎসায়।  কতজন জীবন হারিয়েছে চিকিৎসার ব্যর্থতায়। কতজন জীবন হারিয়েছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়ায়।

সংক্রামক ব্যাধির অনেক রূপ। কখনো তার উপসর্গ সাময়িক, যা চিকিৎসা ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে উপসমযোগ্য। কখনো তার প্রয়োজন কার্যকরী প্রতিষেধক: যেমন হারপিস ভাইরাসজনিত, ব্যাকটেরিয়াজনিত, ফাঙ্গাসজনিত বা প্যারাসাইটজনিত রোগের ক্ষেত্রে। আবার কখনো সংক্রামক রোগ জীবনের হুমকি স্বরূপ, যেমন শরীরের অভ্যন্তরে মারাত্মক সংক্রমণে বা সার্জারির সাথে সম্পর্র্কিত সংক্রমণে। কিন্তু সমস্যা হল উপসর্গ দেখে বুঝার উপায় নেই যে রোগ কোন দিকে মোড় নিবে। সেকারণেই প্রয়োজন ল্যাব টেস্ট। সেকারণেই প্রয়োজন ইমেজিং অর্থাৎ এক্সরে , সিটিস্ক্যান বা এমআরআই।  একারণেই প্রয়োজন রোগের কারন বুঝে চিকিৎসা দেওয়া বা না দেওয়া। ল্যাব টেস্ট করে যদি ভাইরাস সনাক্ত করা হয় তবে রোগীকে অনর্থক এন্টিবায়োটিক দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আবার যদি কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস সনাক্ত করা হয়, তবে আরো ল্যাব টেস্ট করে জানা যাবে, কোন এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্টেন্স তৈরী হয়েছে, আর কোন এন্টিবায়োটিক কার্যকরী হবে। সেকারণে ল্যাব টেস্টের ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রদান করলে বা চিকিৎসার পরিবর্তন আনলে রোগী সঠিক চিকিৎসা পাবে, এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যববহার নিয়ন্ত্রণ হবে, আর সেই সাথে রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরী হবার ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রিত হবে।

সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে রোগীর সঠিক চিকিৎসাসেবা প্রদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ। কারণ অন্যান্য রোগের সাথে এর তফাৎটা এখানেই।  সংক্রামক রোগ অন্যতে সংক্রমিত হতে পারে, আর তার ফলাফল হতে পারে ভয়ঙ্কর। ব্যাক্তিগত সমস্যা থেকে সামাজিক।  সামাজিক সমস্যা থেকে জাতীয়।  আর জাতীয় সমস্যা থেকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে সংক্রামক রোগ। আজকের করোনা ভাইরাস মহামারী ঠিক এমনি একটি রূপ ধারণ করেছে। একারণেই প্রয়োজন সংক্রামক রোগের সঠিক কারণ জানা। ল্যাব টেস্ট এর মাধ্যমে রোগের সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত করা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাতে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সংক্রামক রোগ যখন মহামারী আকার ধারণ করে তখন তার ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন সর্বোচ্চ মনযোগ। প্রয়োজন চিকিৎসকদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার মানুষের সংশ্লিষ্টতা।  

করোনাভাইরাস এর মহামারী নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকেই দুর্নীতি ও অবহেলা ছাড়াও একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত ও বিলম্বিত সিদ্ধান্ত লক্ষ্যণীয় ছিল। দেশে  করোনাভাইরাস বিষয়ক একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটির হয়েছে। সেখানে দুএকজন ভাইরোলজিস্ট বাদ দিয়ে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ আছেন, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট আছেন , নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ আছেন , এমনকি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আছেন কিন্তু এই জাতীয় কমিটিতে দেশের প্রথিতযশা যে দু তিনজন নন-ফিজিশিয়ান ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলোজিস্ট রয়েছেন, ইনফেকসাস ডিজিজ এক্সপার্ট রয়েছেন,  ইনফেকসাস ডিজিজ ডায়াগ্নোস্টিক্স, ট্রিটমেন্ট , ভ্যাকসিন ও ইনফেকশন কন্ট্রোল বিষয়ে যাদের রয়েছে অনেক বছরের অভিজ্ঞতা, দেশের বাইরেও যারা স্বীকৃত এমন সব কন্সাল্ট্যান্টরাও নেই এই কমিটিতে। অবস্থাদৃষ্টে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে জীবাণুঘটিত একটি মহামারী মোকাবিলায় দেশের আশু প্রয়োজনগুলো বোঝার মতো অবস্থাও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বা তাদের পরামর্শকদের মধ্যে নেই। এসবই বছরের পর বছর উপেক্ষা ও অবহেলার ফল। শুধু করোনাভাইরাস নয়।  গত কয়েক বছরে চরম ব্যর্থতার পরিচয় পাওয়া গেছে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া মোকাবেলায়, যেসবেরের নিয়ন্ত্রণ ছিল তুলণামূলক ভাবে অনেক সহজ।  আজকের পরিস্থিতি তাই খুব একটা বিস্ময়ের ব্যাপারটা নয়।  

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী নিয়মন্ত্রনের মূলমন্ত্র হলো প্রতিরোধ, প্রতিশোধ নয়।  টেস্ট, ট্রেইস এন্ড আইসোলেইট । আর ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে এই তিনটি কাজ সফল ভাবে প্রয়োগ করতে হলে প্রয়োজন একজন সফল মহামারী ব্যবস্থাপকের অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল যার মধ্যে থাকবে ইনফেকশন কন্ট্রোল এক্সপার্ট, ইনফেকসাস ডিজিজ এক্সপার্ট, মেডিকেল/ক্লিনিকাল ভাইরোলজি বা মাইক্রোবায়োলজি কনসালটেন্ট, এপিডেমিওলোজিস্ট, বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট, ল্যাবরেটরি কনসালটেন্ট , ল্যাবরেটরি ম্যানেজার , নার্সিং কনসালটেন্ট, তথ্য প্রযুক্তিবিদ , অর্থনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কনসালট্যান্ট , ডায়াগষ্টিক সেন্টার গুলোর প্রতিনিধি , ভ্যাকসিন এক্সপার্ট, হাসপাতাল প্রতিনিধি, এয়ারপোর্ট ম্যানেজার , বিশ্ব্য স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি ইত্যাদ। করোনাভাইরাস মহামারী একটা বহুমুখী সমস্যা। তাই এর সমাধানটার জন্যও প্রয়োজন বহুমুখী দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও ব্যবস্থাপনা । তাহলে এবিষয়ে যে জাতীয় কমিটি সরকারকে পরামর্শ দিবে তা মাল্টিডিসিসিপ্লিনারি হওয়া একান্ত প্রয়োজন।  

করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণ মানে কিন্তু শুধুই করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা নয়। সবার আগে প্রয়োজন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রন। তা যদি না হয় তবে রোগী আসতেই থাকবে স্রোত থেকে মহাস্রোতের মত। ভেঙে পড়বে স্বাস্থব্যবস্থা। ভেঙে পড়বে পরিবার, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। মহামারী ব্যবস্থাপনায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পরামর্শ প্রদানে সংশ্লিষ্ট সব পেশার মানুষদের এবং সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্টদের  এখুনি নিয়োজিত না করলে সংক্রমণের হার রেল লাইনের মতোই সমান্তরাল গতিতে চলতে থাকবে আর হারাতে থাকবে মূল্যবান প্রাণ।

শত বছরের পুরোনো মহামারী আর আজকের মহামারীতে তফাৎ অনেক।  শত বছর আগে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল ভিন্ন।  মানুষ মূলত নিজ নিজ অবস্থানেই সীমাবদ্ধ থাকতো।  মানুষ ছিল স্থানীয় সম্পদের উপর নির্ভরশীল।  বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও মানুষ প্রকৃতির সাথে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আদান প্রদান করেই বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেত।  আজকের যুগে মহামারীর প্রভাব ভিন্ন। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি যোগাযোগনির্ভর।  সাপ্লাই চেইন নির্ভর, ক্রয় ক্ষমতা নির্ভর।  সে হিসেবে জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হলেও মহামারিকালে মানুষের নির্ভরশীলতাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত।  শুধু মহামারিজনিত স্বাস্থ্য বিষয়ক নিৰাপত্তা নয়, মানুষের দৈনিন্দিন ব্যাক্তিগত , অর্থনৈতিক, পেশাগত ও সামাজিক জীবন প্রভাবিত। কাজেই সংক্রামক ব্যাধির সঠিক ব্যবস্থাপনাকে পায়ে ঠেলে দিয়ে বিপদ থেকে উত্তরণ হবে না বরং সমস্যা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে।

লেখক: পি.এইচ.ডি., ডি(এ.বি.এম.এম.), এফ.সি.সি.এম.
ক্লিনিকাল মলিকুলার মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, সিদরা মেডিসিন
সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ, দোহা, কাতার

ইত্তেফাক/এমএ/আরএ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন