শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

প্লাস্টিক দূষণ: প্রশ্নের মুখে মানবসভ্যতা

আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:৪৬

চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে পরিবেশে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বেড়েছে প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। সম্প্রতি কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চল দেশের সর্বত্র স্বাস্থ্য সচেতনতা রক্ষার্থে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে কয়েক গুণ।

এসব প্লাস্টিক সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে সার্জিক্যাল ফেসমাস্ক, সার্জিক্যাল হ্যান্ডগ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আরো রয়েছে পলিথিনের তৈরি পাতলা হ্যান্ড গ্লাভস, পলিথিনের ব্যাগ, দোকান থেকে বাসাবাড়িতে খাবার সরবরাহের জন্য ব্যবহূত নানা ধরনের মোড়ক। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন না করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে আশপাশের ড্রেনে, রাস্তার পাশের ভাগাড়ে বা জলাশয়ে। এর ফলে মাটি, পানি, বায়ুর মতো পরিবেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহে মারাত্মক দূষণ দেখা দিচ্ছে।

বর্তমানে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এক বড় অংশ দখল করে আছে। গৃহকর্মের প্রয়োজনে, অফিসে-আদালতে, স্কুল-কলেজের ফুডশপগুলোতে, বিয়ে বাড়িসহ ছোট-বড় সব অনুষ্ঠানে এখন খাবার সরবরাহের ঝামেলা এড়ানোর জন্য সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পর আমরা যত্রতত্র ফেলে রাখি। এ ধরনের প্লাস্টিক রিসাইকেল করা যায় না। এগুলো গিয়ে জমা হচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিলে। এতে করে পরিবেশ দূষণের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, এয়ারলাইনস, স্ট্রিট ফুডশপ থেকে ব্যাপক হারে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য আসছে। এসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে টুথপেস্টের টিউব, প্লাস্টিকের টুথব্রাশ, শ্যাম্পো-কন্ডিশনারের মিনিপ্যাক, শ্যাম্পোর বোতল, টি-ব্যাগ, বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম ইউজড চামচ, কাপ, প্লেট, গ্লাস, স্ট্রসহ নানাবিধ প্লাস্টিকের সামগ্রী। আমাদের নিত্যদিনে ব্যবহার্য প্লাস্টিকের তৈরি এ পণ্যগুলো পরিবেশে টিকে থাকতে পারে বছরের পর বছর ধরে।

বিজ্ঞানের অন্যান্য চমকপ্রদ আবিষ্কারের মতো প্লাস্টিকের আবিষ্কারও ছিল চমকপ্রদ ও কল্যাণকর। তবে প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা আজ মানবসভ্যতাকে ফেলেছে এক ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তাদের এক গবেষণায় বলেছেন, চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয় সরবরাহের জন্য ব্যবহূত প্লাস্টিকের কাপ ৫০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকে। মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশতে ২০ বছর সময় লাগে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল প্রায় ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না। প্লাস্টিক দূষণের ফলে পরিবেশের প্রতিটা স্তরের প্রাণী রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে।

আমাদের দেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফলে কৃষিকাজের সহায়ক, হাজারো মানুষের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম, প্রোটিনের অন্যতম আধার এ নদীগুলো নাব্য হারিয়ে ফেলছে দিন দিন। ফলে দেশের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন তৈরি করে, কখনো কখনো ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগও ঘটায়। তাছাড়া প্লাস্টিক উত্পাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাসসমূহের নিঃসরণ ঘটে। সর্বোপরি, প্লাস্টিক দূষণ আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকি সৃষ্টি করছে, মানবজাতিকে নিয়ে যাচ্ছে এক করুণ পরিণতির দিকে।

প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে প্লাস্টিক বর্জ্যের নিচে চাপা পড়বে মানবসভ্যতা। সময় এখন এ মারাত্মক দূষণ ঠেকানোর জন্য সোচ্চার হওয়ার। প্লাস্টিক দূষণ হ্রাস করার জন্য আমাদের উত্পাদন ব্যবস্থা, ভোগ, বণ্টন, ভোক্তা আচরণ ও রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। প্লাস্টিক দূষণ রোধের কার্যক্রমকে গতিশীল করে তুলতে ভোক্তা, উদ্যোক্তা, মিডিয়াকর্মী, নেতাকর্মী সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। সাধারণ আমজনতাকে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারে নিরুত্সাহিত করতে হবে।

প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্লাস্টিক পণ্যের ওপর অধিকহারে শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। এতে করে এসব পণ্যের উত্পাদন কমবে দেশে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সর্বত্র পাটজাত পণ্যের প্রাপ্তি সুলভ করতে সরকার এসব পণ্য উত্পাদনে ভর্তুকি প্রদান করে উত্পাদনকারীদের উত্সাহী করে তুলতে পারে অনায়াসে। পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেলে প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিবেশ মন্ত্রণালয় অধিক গুরুত্বারোপ করতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি—ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরকার, গণমাধ্যমকর্মী, পলিসি মেকার, নেতাকর্মীরা এই পৃথিবীর কল্যাণের কথা চিন্তা করে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন