শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বন্ডেড ওয়্যারহাউজের মাল খোলাবাজারে

আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৯, ২১:২৮

ড. আর এম দেবনাথ

প্রতি বছর সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হয়, টাকার অভাবে সরকার উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বড়ো করতে পারে না, অথচ প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেন একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা। অনেক কোম্পানি আবার সরকারের পাওনা টাকাও দিতে চায় না। এসব নিয়ে, বিশেষ করে প্রথম সমস্যাটির ওপর কিছুদিন আগে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম :‘বন্ড জালিয়াতিতে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা, তালিকায় শতাধিক গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান, গোয়েন্দা নজরদারিতে তিন বড়ো মাপের ব্যবসায়ী যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার’। শিরোনামটি পাঠ করলেই যে কোনো পাঠক বুঝতে পারবেন সমস্যাটি কত ঘোরতর। খবরটির ভেতরে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিদেশে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এতে কমপক্ষে ২৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। খবরটির সূত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২৮ হাজার কোটি টাকা নয়, এই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরই শীর্ষ একজন কর্মকর্তা আজ থেকে বছর দুয়েক আগে বলেছিলেন, ‘বন্ড’ সুবিধার অপব্যবহার করে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বছরে প্রায় ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেন। অথচ আমরা জানি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৫০-৫৫ হাজার কোটি টাকা। ভাবা যায়, ঘটনাটা কী ঘটছে? কীভাবে এটা ঘটছে? সরকারের ‘বন্ড’ সুবিধা বলে একটা সুবিধা আছে। এটা রপ্তানিকারকদের জন্য বিশেষ করে ‘গার্মেন্টস’ কারখানা এবং অন্যান্য নির্বাচিত কিছু রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য। এসব শিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকার তাদের শুল্কমুক্ত আমদানির সুযোগ দেয়, যাতে মালের দাম কম থাকে। শর্ত একটা, মাল আমদানি হবে, তা ‘বন্ডেড ওয়ারহাউজে’ ঢুকবে, সেখান থেকে সরাসরি তত্ত্বাবধানের আওতায় কারখানায় যাবে, রপ্তানিযোগ্য মাল তৈরি হবে। সেখান থেকে সেই মাল সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে উঠবে। এই মাল কোনোভাবেই দেশের খোলাবাজারে বিক্রি করা চলবে না। তা ব্যবহার করতে হবে রপ্তানির জন্য। এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যাতে গার্মেন্টসসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্প বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে মাল বিক্রি করতে পারে। আমদানির ওপর শুল্ক বসালে মালের দাম বেশি পড়বে, এতে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। এমন একটা সত্ উদ্দেশ্যে করা সুবিধাটির দারুণ অপব্যবহার হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এর ওপর খবর হচ্ছে নিয়মিত। সর্বশেষ রোমহর্ষক খবরটি হচ্ছে ‘ইত্তেফাকের’। ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউজের’ মাল ঢাকার ইসলামপুরে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এই মাল রপ্তানি হওয়ার কথা। এই বেআইনি ব্যবসায় জড়িত একটা প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। খবরে দেখা যাচ্ছে, ‘বন্ডেড’ সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা কাপড়, প্লাস্টিক দ্রব্য, কাগজপণ্য, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, কার্ডবোর্ড, প্রিন্টিং ইঙ্ক ইত্যাদি পণ্যদ্রব্য উত্পাদনের কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, এসব বেআইনি কাজে জড়িত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১ হাজার ৬৯৭টি প্রতিষ্ঠানই পোশাক কারখানা। ভাবা যায় এ ঘটনার কথা? যে ‘গার্মেন্টস’ শিল্প আমাদের গর্ব-অহংকার, যার জন্য সরকার কত রকমের সুবিধা দেয়, যে শিল্প হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে, সেই শিল্পের সঙ্গে জড়িত একশ্রেণির ব্যবসায়ী রপ্তানির জন্য শুল্কমুক্তভাবে মাল এনে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। এর ফল কী? এর ফল হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয়ভাবে মাল আমদানি করে বিদেশে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়। দুই নম্বর অসুবিধা হচ্ছে, এতে সরকার বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তৃতীয় বড়ো অসুবিধা হচ্ছে, এই অবৈধ কাণ্ডের ফলে দেশীয় শিল্প মার খায়। তৈরি পোশাকশিল্পের কথাই বলা যাক। এই শিল্পে সরকার কী কী সুবিধা দেয়? এসব শিল্পের করপোরেট করহার সর্বনিম্ন। নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নের সময় এদের করপোরেট করহার আরো কমানো হয়। উেস কর্তনযোগ্য অগ্রিম আয়করের হার তাদের জন্য সর্বনিম্ন। তারা শুল্কমুক্তভাবে মাল আমদানির সুবিধা পায়। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে অর্থসাহায্য পায়। কম দামে ঋণ পায়। গ্যাস বিল, বিদ্যুত্ বিল, টেলিফোন, বন্দর সেপ ইত্যাদিতে কর অব্যাহতি পায়। আইটি সেপ, শ্রমিককল্যাণ ইত্যাদিতে ভ্যাট মুক্তির সুবিধা পায়। এত সুবিধা পাওয়ার পরও কেন একশ্রেণির অসাধু পেশাক রপ্তানি ব্যবসায়ী ‘বন্ডেড’ ওয়ারহাউজের সুবিধার অপব্যবহার করে পুরো শিল্পের জন্য বদনাম কামাই করছেন, তা এখন বিরাট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শুধু গার্মেন্টস নয়, দেখা যাচ্ছে যে এই সুবিধার অপব্যবহার করছে আরো কয়েকটি শিল্প। সুবিধা অপব্যবহারকারীদের মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারাই বেশি আলোচনায় আসছে। আরো সামনে আসছেন বস্ত্রশিল্পের মালিকদের জন্য। তারা যারা বছর ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছেন যে অবৈধভাবে ইসলামপুরের খোলাবাজারে ‘বন্ডের’ মাল, কাপড় বিক্রির কারণে তাদের বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয় হয়। অথচ সরকার ‘ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ’ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে বস্ত্রকল যাতে দেশে গড়ে ওঠে, তার জন্য প্রচুর উত্সাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। পোশাক কারখানাগুলো বিদেশ থেকে কাপড় আমদানি না করে দেশীয় শিল্প থেকে কাপড় নেবে, তা থেকে জামা-কাপড় তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করবে। এর ফলে ‘ভ্যালু এডিশন’ বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে। এই কর্মকাণ্ডও এখন দারুণভাবে বিঘ্নিত।

ব্যাকওয়ার্ড লিস্কেজ তৈরির প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হওয়ার উপক্রম। এই শিল্পে ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োজিত। প্রচুর ব্যাকফিন্যান্স এই শিল্পে। বস্ত্রশিল্প এখন দারুণ বিপদে। তারা বন্ডেড মালের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। চীন ও ভারতের কাপড়ের দাম সস্তা। সেই সস্তা মালের সঙ্গে খোলাবাজারে দেশীয় শিল্প প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারছে না। শত শত কোটি টাকা প্রতি বছর তারা লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকে তারা ঋণখেলাপি হচ্ছে। ঋণের অভাবে কাজ বন্ধ হচ্ছে। শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। এক প্রশ্ন থেকে আরেক প্রশ্ন আসে। যেমন ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্ডেড ওয়ারহাউজ সুবিধার আওতায় রপ্তানির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আবাধে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে দিনের পর দিন। প্রতি বছর আমদানি পর্যায়েই সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্কমুক্তি দেয়। স্থানীয় পর্যায়ের ভ্যাট যোগ করলে এই সুবিধার পরিমাণ আরো অনেক বেশি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রপ্তানি তো দূরের কথা, বন্ডেড সুবিধার জন্য তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির কোনো অস্তিত্বই নেই। এবং এসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যাই বেশি। এই খবর আমাদের জন্য খুবই খারাপ। পোশাকশিল্পের জন্যও খারাপ। তাদের ভাবমূর্তির জন্যও খারাপ। যেমন তাদের সম্পর্কে কথা উঠেছে এবং কথাটি তুলেছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, পোশাকশিল্পের মধ্যে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেশি। মুশকিল হচ্ছে, তারা এত ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী যে এরা অবৈধ কাজ করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। ইত্তেফাকের প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, বন্ডেড মাল তদারকির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের যে জনবল দরকার তা নেই। এরই মধ্যে কোনো কর্মকার্তা এসব মাল ধরতে গেলে তাকে বদলি করে দেওয়া হয়। তাদের দাপট এত বেশি যে এখন প্রশাসন তাদের কাছে অসহায়। দৈনিক ইত্তেফাকের এসব খবর পাঠ করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু এখানে প্রশ্ন ওঠে একটি। সব জায়গায় নিয়ম-কানুন মানার জন্য একটা ব্যবস্থা আছে। ডাক্তার, উকিল, সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি কর্মচারী সবার চাকরি বা কর্মক্ষেত্রে আচরণবিধি আছে। কেউ তা অমান্য করলে এর বিচার-আচারের ব্যবস্থা আছে। প্রশ্ন, যেসব অসাধু ব্যবসায়ী কাপড়, প্লাস্টিক দ্রব্য, কাগজপণ্য, ডুপ্লেক্স বোর্ড ইত্যাদি শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে, তারা কি কোনা না-কোনো ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়? ‘চেম্বার  অব কমার্স’ আছে, ‘ফেডারেশন’ আছে, প্রতিটি ব্যবসার জন্য আলাদা আলাদা ‘চেম্বার’ আছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কি তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না? যে কারখানার কোনো অস্তিত্ব নেই, সেই কারখানা কী করে মাল আমদানি করে? ব্যাক টু ব্যাক এলসি তারা কীভাবে খোলে? ব্যাংক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের অডিট বিভাগই বা কী করে? অস্তিত্বহীন কারখানা কীভাবে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে? এফবিসিসিআই বলে প্রভাশালী একটা প্রতিষ্ঠান আছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কি তাদের কোনো নৈতিক দায়িত্ব নেই? অসাধু ব্যবসায়ীরা কীভাবে চেম্বারের সদস্য থাকে? চেম্বারের সদস্য না হয়ে কীভাবে তারা ব্যবসা করে, বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স পারমিট পায়? অনেক প্রশ্ন, যার কোনো উত্তর নেই। মোট কথা, এই ফাঁকেই একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ফুলেফেঁপে উঠছে। তারা অবৈধভাবে টাকা কামাই করছে, টাকা পাচার করছে। তারা রাজনীতিতে ঢুকছে, ক্ষমতা সংহত করছে। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পকে আইনের মধ্যে আনতে হবে। ব্যবসা চলবে সমভাবে প্রযোজ্য পরিবেশে। তারা ব্যবসা করবেন মেধা ও শ্রমের ভিত্তিতে, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। ফ্রি স্টাইলে ব্যবসা করার ব্যবস্থা বিলোপ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট খবরটিতে দেখলাম, যে সিন্ডিকেট এই অবৈধ ব্যবসায় জড়িত, তারা এখন সরকারের নজরদারিতে। এদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আশা করি, অচিরেই এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ হবে। রপ্তানিমুখী শিল্প আইনের অধীনে কাজ করবে। ফলে দেশীয় শিল্প বাঁচবে, সরকারের রাজস্ব ক্ষতি কম হবে। ইত্যবসরে কয়েকটি সুপারিশ কি করা যায়? ‘গার্মেন্টস’ শিল্পসহ রপ্তানিমুখী শিল্প, যারা বন্ডেড সুবিধার অধীন, তাদের ওপর একটা সমীক্ষা হওয়া দরকার। এসব শিল্পের অবদান অর্থনীতিতে প্রকৃতপক্ষে কতটুকু তা বের করা দরকার। এরা ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে জড়িত কি না, রপ্তানিকৃত পণ্যের সব টাকা দেশে তারা আনে কি না, রপ্তানির ওপর প্রযোজ্য ‘রিটেইনড কোটার’ বৈদেশিক মুদ্রা সঠিকভাবে ব্যবহার করে কি না—এসব বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করছে কি না, এসব প্রতিষ্ঠানের মূল্যসংযোজন (ভ্যালু এডিশন) হার কেমন, এদের বন্ডেড সুবধাি দেওয়ার ফলে স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, তা-ও দেখা দরকার। রপ্তানিমুখী শিল্পের অনেকগুলোতে হাজার হাজার বিদেশি বৈধ-অবৈধভাবে কাজ করে বলে শোনা যায়। তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা তাদের দেশে নিয়ে যায়। এ বিষয়টিও তলিয়ে দেখা দরকার। আমার মনে হয়, এসব করার সময় হয়েছে। এদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যই তা দরকার। শত হোক, সারা জীবন অক্সিজেন দিয়ে কাউকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

n লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়