শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দ্বিতীয় পর্ব

জীবনানন্দের 'আট বছর আগের একদিন'

আপডেট : ২৫ মে ২০২০, ১৮:২৯

গতকালের পর  

বলে রাখা ভালো, পুরো ব্যাপারটিই এক ধরনের ‘বাস্তববাদিতা’র সঙ্গে যুক্ত, বিশেষ রকমের ‘বস্তুবাদিতা’র সঙ্গে যুক্ত। বস্তুগত উপাদান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্পর্শযোগ্য বা উপলব্ধিযোগ্য বাস্তবের নিকটবর্তী থাকা—সে বাড়ির কাছের ঘাস-ফুল-লতা-পাতা হোক আর হংকং, মিশর বা পুরানা দুনিয়ার কোনো উপকরণ হোক, এবং সে উপাদানের বস্তুধর্ম মান্য করে কাব্যকলা উদ্ভাবন করা জীবনানন্দের কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ‘আট বছর আগের একদিন’ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা যাক:

অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে 
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

এ অংশটিতে কয়েকটি উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে—অশ্বত্থ, জোনাকি, পেঁচা, চাঁদ, ইঁদুর। উপাদানগুলো যে নিপুণ ভাবগত ঐক্যে বিন্যস্ত হয়েছে তা বস্তুত অসাধারণ। কিন্তু প্রথমেই বিশেষভাবে চোখে পড়ে স্থানগত ঐক্য। বিজন মাঠের এক অশ্বত্থ গাছের ডাল বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহে সাড়া দিয়ে দুলতে পারে, এবং সে দুলুনি হাতনেড়ে বা মাথানেড়ে ‘না’ বলার সমার্থক গণ্য হতে পারে। এ ধরনের জায়গা দলবদ্ধ জোনাকির অবাধ বিচরণক্ষেত্র। পেঁচা আর ইঁদুরেরও স্বাভাবিক আবাস। এখন এই সবগুলো উপাদান একত্রে যদি একটা চলচ্ছবি তৈয়ার করে, যদি এর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় উপাদান হিসাবে—মূল ফোকাস হিসাবে—দড়ি-হাতে আত্মহত্যা করতে যাওয়া লোকটিকে যোগ করা হয়, তাহলে আমরা উপরের কবিতাংশে বর্ণিত ‘স্বাভাবিক’ ছবিটি পাব। স্বাভাবিক এ অর্থে যে, উপাদানগুলোর স্থানান্তর বা পুনর্বিন্যাস ব্যতীতই এ ছবি সম্ভবপর। বলা যায়, কবিতাংশটি প্রাথমিকভাবে বাস্তবের সীমা আক্ষরিক অর্থে মান্য করেই নির্মিত হয়েছে। সবগুলো ছবিই উপস্থাপিত হয়েছে আত্মহত্যার বিপরীতে জীবনের ‘তুমুল গাঢ় সমাচার’ হিসাবে। আগে ব্যাঙ, মশা, মাছি বা ফড়িঙের যেসব ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এ অংশের একটা গোড়ার ফারাক আছে। ওই ছবিগুলোও প্রাত্যহিক বাস্তব থেকে নেয়া। উপাদানের বস্তুধর্ম রক্ষা করেই বানানো। কিন্তু ওগুলো অন্তত বাংলা অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে সর্বস্থানিক এবং সর্বমানবিক। উপস্থাপনের ধরনটাও সেরকম। আর উপরে উদ্ধৃত অংশটি বিশেষ স্থান-কালে এক ব্যক্তির বিশেষ মানসিক অবস্থার বাস্তবতায় নির্মিত। এই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে কবি এরপর অনায়াসেই বলতে পারবেন, এসব প্রাণচঞ্চল উপভোগ্য উপাদানগুলো কখনো কখনো অর্থহীন হয়ে ওঠে। যেমন হয়েছিল এ লোকটির ক্ষেত্রে, আট বছর আগে।

জীবনানন্দের কবিতা বাস্তববাদী নয়, কিন্তু—দেখা যাচ্ছে—তিনি বাস্তবের ভিত্তিতেই কথা গড়েন। বাস্তবকে উপস্থিত করেন দ্বান্দ্বিক মেজাজে, আর বক্তব্যকে গ্রাহ্য করতে প্রায় প্রাবন্ধিক গদ্যের ধরনে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাঁর কবিতার বহু-ব্যবহৃত ‘তবু’ আর ‘তাই’ যথাক্রমে দ্বান্দ্বিক মেজাজ আর যৌক্তিক বিবরণীর চিহ্ন হিসাবেই পাঠযোগ্য।

ঘটনা ঘটার বহুদিন পর কবি এই আত্মহত্যা-বিষয়ক সন্দর্ভ রচনা করেছেন। রচনাভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, তিনি ভাবনাচিন্তার জন্য যথেষ্ট সময় নিয়েছেন। বিচিত্র সম্ভাব্য দিক খতিয়ে দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। খুবই মার্জিত চৌকস এক ভঙ্গিতে তিনি তাঁর কথাগুলো উপস্থাপন করেছেন। বস্তুত, উপস্থাপনার বিশিষ্ট ভঙ্গির কারণেই কেবল কথাগুলো কার্যকরভাবে বলা গেছে। 

বিবরণীটি আছে আমাদের আগে-বলা দ্বিতীয় অংশে। দুই স্তবকে। প্রথম স্তবকে বলা হয়েছে, এই ব্যক্তি জাগতিক প্রাপ্তির বর্ণাঢ্যতায় জীবনযাপন করছিল। তার জাগতিক অভাব-অনটন ছিল না। আবেগ ও মননের অভাবজনিত সঙ্কটও ছিল না। সবকিছুর পরও সে আত্মহত্যা করেছে। এ স্তবকের সিদ্ধান্তটি খুব মজার। বলা হচ্ছে, তার কোনো সমস্যা নাই বলেই সে আত্মহত্যা করেছে: ‘তাই/লাশকাটা ঘরে/চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।’ পরের স্তবকে কারণ ব্যাখ্যার চেষ্টা আছে। স্তবকটি কথা বলেছে সাধারণ সূত্রের মতো করে। বলেছে, মানুষের জাগতিক প্রাপ্তিকে তার চূড়ান্ত মোক্ষ ভাবার কোনো কারণ নাই। সব থাকার পরও এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’ তাকে অভিভূত করতে পারে। সব থাকা যেমন ক্লান্তির জন্ম দিতে পারে, তেমনি ওই বিপন্নতাও ঘাতক ক্লান্তির জন্ম দিতে পারে। পরিণতি একই—আত্মহত্যা। আগের স্তবকের কথাগুলো এ স্তবকেও সিদ্ধান্ত-বাক্য হিসাবে বলা হয়েছে। ‘তাই’ অব্যয়টি প্রমাণ করে, কবি যৌক্তিক সিদ্ধান্তই নিতে চেয়েছেন। কিন্তু দুই কার্যকারণের একই পরিণতি প্রমাণ করে, কোনো একাট্টা সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেই সম্ভবপর নয়। 

কারণ অনুসন্ধানের স্তবক দুটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য হল, কী কারণে লোকটি আত্মহত্যা করে নাই, তা সাড়ম্বরে বলা হয়েছে; কিন্তু কী কারণে করেছে তার স্থিরনির্দিষ্ট নির্দেশনা নাই। দ্বিতীয় স্তবকের ‘বিপন্ন বিস্ময়’কে এবং তজ্জনিত ক্লান্তিকে যদি কারণ হিসাবে ধরি, তাহলে কারণটি এতই অনির্দিষ্ট এবং বিমূর্ত হয় যে, একে ঠিক কারণ বলা যায় না। বরং কারণ নির্ণয় করা যে দুরূহ, সে বোধই প্রবল হয়ে ওঠে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র বিখ্যাত ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পে এ ধরনের কৌশল পাওয়া যায়। তুলসী গাছটি কেন উপড়ে ফেলা হল না, কিংবা গোপনে কে এর যত্ন নিচ্ছে, তার তদন্ত গল্পের এক পর্যায়ে জরুরি হয়ে উঠেছিল। তখন বলা হল, কারণটি এরকম নয়, ওরকম নয়, সেরকমও নয়। কিন্তু কী রকম তা আর বলা হল না। তাতে করে ওই না-বলা কারণটাই হয়ে উঠল গল্পের গভীরতর মূল। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার ক্ষেত্রেও এ ধরনের কাব্যকৌশলের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, মানুষের আত্মহত্যার যতগুলো কারণ কল্পনা করা যায়, যতগুলো কারণ অতীত ইতিবৃত্ত বা বাস্তব তথ্য-উপাত্ত থেকে শনাক্ত করা যায়, এ লোকটি তার বাইরের কোনো কারণে আত্মহত্যা করেছে। ঠিক এখানে এসে কবিতাটি আর বিশুদ্ধ আত্মহত্যার কবিতা থাকছে না। বরং হয়ে উঠছে মানুষ-বিষয়ক এক নিগূঢ় সন্দর্ভ। কারণ আত্মহত্যার কারণজনিত এই অনির্দিষ্টতা স্পষ্টতই প্রমাণ করে, মানুষ সম্পর্কে বস্তু বা যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে নেয়া সম্ভব নয়। ইতর প্রাণী সম্পর্কে নেয়া যায়। প্রকৃতি সম্পর্কে নেয়া যায়। মানুষ সম্পর্কে নয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। এ মানুষ কোন মানুষ? কী তার ভাব-স্বভাব?
কবিতাটিতে মানুষ সম্পর্কে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা আছে। ‘আমরা’, ‘মানুষ’ ইত্যাদি শব্দের বিচিত্র ব্যবহারের মধ্যে তা স্পষ্ট। কিন্তু এই ‘মানুষে’র মধ্যে সব মানুষ সম্ভবত অন্তর্ভুক্ত নয়। কবি সরাসরি মানুষকে ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করে নিয়েছেন। ঠিক তেমনি ‘বিপন্ন বিস্ময়’ বোধ-করা মানুষদের থেকেও বিপুল আম-জনতাকে আলাদা করেছেন। ব্যাপারটি বিশেষভাবে ঘটেছে কবিতার শেষ-অংশে।

কবিতার তৃতীয় অংশের জটিলতা আর দ্ব্যর্থকতার মূলে আছে ‘আমি’। এ ‘আমি’ পেঁচার সাথে একাত্ম হয়ে ‘দুজন’ তৈরি করলে হিসাবটা আরো জটিল হয়ে যায়। ফলে ভিন্ন রকম পাঠ তৈরি করা ছাড়া উপায় থাকে না। প্রাথমিকভাবে এ ‘আমি’ কথক ‘আমি’ই বটে। আগেই বলা হয়েছে, তিন পর্বে কথক-কবির অবস্থান তিন রকমের। প্রথমে একজন অনুসন্ধানী তৃতীয় পক্ষ—আম-জনতার একজন হয়েও সক্রিয়তায়-লিপ্ততায় আলাদা, কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ নয়। দ্বিতীয় ‘আমি’ এ স্তর ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেকদূর—ঠিক কবি অথবা সৃষ্টিকর্তার বার্তবাহকের মতো। সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কোনো রাখ-ঢাক ছাড়া, নিশ্চিন্ত মেজাজে। মনে রাখা দরকার, ওই সিদ্ধান্তের যে রহস্যময়তা, তা কিন্তু বলা হয়েছে রহস্য না-রেখেই; যে অস্পষ্টতা, তা বলা হয়েছে স্পষ্ট করে। তৃতীয় অংশের ‘আমি’ আসলে নেমে গেছে জনতার কাতারে। মানুষের স্বাভাবিক-সাধারণ জীবনস্পৃহা ও চৈতন্য প্রকাশ পেয়েছে এই ‘আমি’র সংক্ষিপ্ত তীর্যক জবানিতে। পেঁচা-প্রসঙ্গের নিপুণ ব্যবহারই এই ‘আমি’র সংজ্ঞায়ন ঠিক করে দিয়েছে। 

পেঁচা প্রথমবার এসেছে ইতর প্রাণীগুচ্ছের একটি হয়ে। ব্যাঙ, মশা, মাছি ও ফড়িঙের সহযাত্রী হয়ে। কিন্তু প্রথম উল্লেখেই পেঁচা আলাদা অস্তিত্বেরও জানান দিয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তবুও তো পেঁচা জাগে’। এ উল্লেখ স্বয়ং কোনো অর্থ প্রকাশ করে না, যেখানে মশা বা মাছির প্রসঙ্গগুলো বিস্তারিত বিবরণীর সুবাদে নিজেরাই অর্থবহ হয়ে ওঠে। পেঁচা-সম্পর্কিত এই সংক্ষিপ্ত পংক্তিটি কেবল তখনই অর্থবহ হয়, যখন আগের চাঁদ-ডোবা প্রসঙ্গটিকে মিলিয়ে পড়া হয়। দ্বিতীয় উল্লেখে সে কথাটিই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। চাঁদ ডুবে অন্ধকার হলেই কেবল পেঁচার জীবন শুরু হয়। তার মানেই হল, অন্ধকার কোনো সর্বজনীন অর্থ বহন করে না, যেমন করে না আলো। দ্বিতীয় উল্লেখে ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে’ পংক্তিতে দুটি নিরীহ কিন্তু কার্যকর বিশেষণ ‘বুড়ি’ আর ‘বেনো’ পেঁচার প্রচণ্ড জীবনতৃষ্ণাই প্রকাশ করে এবং পেঁচাকে তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। কবিতার শেষাংশে এই প্রতিষ্ঠিত চরিত্রের সুবিধাই নিয়েছেন কবি। শেষ অংশে পেঁচা প্রসঙ্গে ‘চোখ পালটায়ে কয়’ ইত্যাদি উল্লেখ চরিত্রটিকে আরো দৃঢ় ভিত্তি দেয়। কী সেই ভিত্তি?—

নিঃশর্ত জীবনতৃষ্ণা। মন ও মনন-নিরপেক্ষভাবে অভ্যস্ত পুনরাবৃত্তি আর জৈবিক চাহিদার পরিপূরণই সে জীবনতৃষ্ণার মূলকথা। এ চরিত্রের সমতলে নেমে এসে ‘আমি’ চরিত্রটি আসলে মানুষের মধ্যেও সমধর্মী জীবনতৃষ্ণার প্রতিনিধিত্ব করেছে। আর এভাবে আলাদা হয়ে গেছে ওইসব মানুষ থেকে, যারা অন্তর্গত রক্তের ভিতর বিপন্ন বিস্ময় অনুভব করে।

‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিশয় প্রকট। একে পুরুষের দৃষ্টিতে, পুরুষ নিয়ে পুরুষের জন্য লেখা কবিতা বলা যেতে পারত। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে—সাধারণীকৃত ধারণা সিদ্ধান্ত আকারে উপস্থাপিত হয়েছে যেখানে—‘নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ’ ইত্যাদি উচ্চারণ নারীকে এ কবিতার দুনিয়া আর আবহ থেকে সম্পূর্ণ বাইরে ঠেলে দেয়। প্রতিষ্ঠা করে এক পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামো। ‘ক্যাম্পে’, ‘বোধ’ ইত্যাদি কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এ পুরুষতন্ত্রের দোসর জীবনানন্দের কবিতায় আরো অনেক মিলবে। অন্যদিকে আবার এ কবিতা গভীরভাবে মানবকেন্দ্রিক [এনথ্রোপসেন্ট্রিক]। মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গে মানুষের প্রভেদ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে। শুধু তাই নয়। এই ‘প্রকৃতির কবি’ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করে মানবপ্রকৃতির এক অন্যতর মাত্রার জানান দিয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক মানবকেন্দ্রিকতা আর প্রকৃতির বিপরীতে মানুষকে প্রতিষ্ঠা করার এ উদ্যোগ একটি খাঁটি ‘আধুনিকতাবাদী’ কাব্যপ্রকল্প। সমধর্মী গভীর আধুনিকতাবাদী আরো নানা বৈশিষ্ট্য জীবনানন্দের কবিতায় সুলভ।
তিরিশি কবিদের সামগ্রিক কাব্যপ্রকল্পের সঙ্গে জীবনানন্দের পার্থক্য ক্রমশ অধিকতর পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু আধুনিকতাবাদী জীবন ও শিল্পবোধের কিছু বনিয়াদি উপাদানে এঁদের মিলও উল্লেখযোগ্য। পার্থক্য এই যে, অন্যরা যেখানে আধুনিকতার উপাদানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘোষণা আকারে পেশ করেছেন, জীবনানন্দ সেখানে অবলম্বন করতে চেয়েছেন—করতে পেরেছেন—পরোক্ষতা; রূপকল্পের অসামান্য সব আয়োজনে বলার বদলে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন বোধ-বোধি। এ ধরনের এক পুনরাবৃত্ত আয়োজন ‘ক্লান্তি’।

‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার যেসব পাঠক একে ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র কবিতা বলেছেন, তাঁরা আসলে খুব বাড়িয়ে বলেননি। বস্তুত ক্লান্তিজনিক সঙ্কটের কারণে আত্মহত্যা যদি বৈধ হয়, তাহলে খোদ ক্লান্তিরই মহিমায়ন ঘটে। আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর যদি এক বিপন্ন বিস্ময় খেলা করেই থাকে, তবে তা থেকে শুধু ক্লান্তি নয়, অন্য নানা রস জন্মানোরও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু জীবনানন্দ বিশেষভাবে ক্লান্তি আবিষ্কার করেছেন—বিপন্ন বিস্ময় থেকে ‘বিপন্নতর’ ক্লান্তির উদগমের কথা বলেছেন। সমধর্মী উপলব্ধির পরিচয় আছে জীবনানন্দের বিপুল কবিতায়, যেমন ‘বনলতা সেন’-এ, যেখানে দীর্ঘ মানব-অভিজ্ঞতার উত্তরসূরি হিসাবে কবি-কথক কেবল ক্লান্তিরই ভাগিদার হয়েছিলেন।

আগেই বলা হয়েছে, আত্মহত্যা-বিষয়ক এই কাব্যিক সন্দর্ভ শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছে মানুষতত্ত্বের এক জটিল সমীক্ষা। সে মানুষ প্রকৃতি থেকে আলাদা, ইতর প্রাণী থেকে ভিন্ন, এমনকি জীবের জীবন যাপন করে যে বিপুল আম-জনতা, তাদের থেকেও আলাদা। এ অবস্থান বিপজ্জনক। সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের লিবারেল আলোকপর্ব যে ধরনের ‘মানুষ’-ধারণা উৎপাদন করেছিল, এটি তারই জাত-ভাই। সিদ্ধান্তের এ সঙ্কীর্ণতা থেকে ‘আট বছর আগের একদিনে’র জীবনানন্দ যে বেশ অনেকটা বেঁচে গেছেন, তার প্রধান কারণ ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী’ পন্থায় বক্তব্য উপস্থাপন। ব্যাপারটা একবার খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

এ কবিতায় আত্মহত্যাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে যতই অনিবার্য করে দেখানো হোক, মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থার প্রতি কিন্তু কোনো অনুরাগ বা পক্ষপাত দেখা যায়নি। বরং জীবনদায়িনী সংবাদকে ‘তুমুল গাঢ় সমাচার’ বলে সংবর্ধিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মানবিক পরিস্থিতি হিসাবে আত্মহত্যার পরিস্থিতি আর প্রচণ্ড জীবনতৃষ্ণার চাঞ্চল্য—এ দুই ছবিকে পাশাপাশি স্থাপন করা চলে। এর মধ্যে কবির প্রত্যক্ষ টান প্রথম দলের দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিপুল দলটিও ন্যায্যভাবে হাজির থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব নয় যে, মানুষ জীবনবাদী সত্তা, কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে জীবন নাশ করাও মানবিক পরিস্থিতিই বটে। অন্তর্নিহিত এই বৈশিষ্ট্যই মানুষকে ‘বস্তু’ বা ‘যুক্তি’র স্তরে নিঃশেষ করে দেয় না।

৬.

‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা অবলম্বনে জীবনানন্দের কবিভাষা, বয়ানরীতি আর জীবনদৃষ্টি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে গিয়ে খুব সামান্যই বলা গেল। ছন্দ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ছন্দযতি আর অর্থযতির নিখুঁত বন্ধনে মুক্তক অক্ষরবৃত্তের যে বর্ণাঢ্য আয়োজন রয়ে-সয়ে এই গল্প-বলা সম্ভবপর করে তুলল, তা অকথিতই থেকে গেল। পংক্তি-দৈর্ঘ্যের লীলাচাপল্য, মিল-অনুপ্রাস-পুনরাবৃত্তির সাঙ্গীতিকতা, গতি আর বিরতির সমানুপাতিক বণ্টন ইত্যাদি সম্পর্কেও বলা দরকার ছিল। মুক্তকের ঔদার্যে সুর-লয় অনাহত রেখে কয়েক পংক্তির আস্ত সংলাপ যে ঢুকে পড়ল বার কয়েক, তাও তো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষত, ভূতের মন্ত্রণায় আত্মহননের আহ্বান এবং পেঁচার মন্ত্রণায় জীবনের জয়গান—এই দুই প্রধান প্রতিপক্ষ যখন কবিতায় নিজ নিজ স্বর অক্ষুণ্ণ রেখে প্রবেশ করে, তখন ভাষার কার্যকরতা অন্য এক মাত্রায় উন্নীত হয়। মৃদু,  বিষণ্ণ, দূরাগত সুরটির কথাও বিশেষভাবে বলা দরকার ছিল, লম্বা ক্রিয়াপদ আর থেমে থেমে বলা গল্পে যা সম্ভবপর হল। কিছুই বলা হল না। শরীরের কথা হল খানিকটা, খানিকটা মনের কথাও; কিন্তু শরীর-মনের প্রত্যক্ষতার বাইরে ওই শরীর-মন-জাত যে লাবণ্য বা আধ্যাত্মিকতা, তার কথা অধরাই থেকে গেল।

ইত্তেফাক/আরএ