বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশের ৫২টি জেলায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে বৈশ্বিক মহামারীটির প্রথম সংক্রমণ ঘটে ৮ মার্চ। মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি বেশ দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত 'সাধারণ ছুটি' ঘোষণার পরে পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল সংক্রমণ ঠেকানো। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে 'লকডাউন' কিছুটা হলেও কাজে লেগেছে। লকডাউন পদ্ধতি ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতির চেয়ে মানুষের জীবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে পৃথিবীর বহু দেশ এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অর্থনীতির বিবেচনায় যাই হোক, এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। তবে সবকিছুর পরেও আমাদের অর্থনীতির ভাবনা হালকা ভাবে দেখার সুযোগ নেই। লকডাউনে এসে তো মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। সকল শ্রেণীর মানুষ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকছে দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষের। কবে 'লকডাউন' উঠবে কবে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি, তার কোনও দিশা দেখতে পাচ্ছে না মানুষ।
'লকডাউন' এর মত পরিস্থিতিতে মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গুলোর কথাও ভাবতে হবে। দেশ থেকে মাদক নির্মূলে সরকারের সাথ সাথে বেসরকারি মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গুলো মাদকের ভয়াল থাবা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় ও মাদকাসক্তদের পুনরায় কর্মক্ষম করতে নিরলস ভাবে কাজ করছে। মাদকের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্র সমূহকে অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
এবিষয়ে 'পীসফুল লাইফ' নামে একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিক মনির হোসেন বলেন, "আমরা মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করি। ঢাকা শহরে গত সাতবছর আমি প্রতিষ্ঠান চালাই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগী আসে। এখন রোগী না-আসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মত অবস্থা হয়েছে। লকডাউনের সময় আমার সেন্টারে অনেক রোগী বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। ভেবেছিলাম দ্রুত লকডাউন উঠে গেলে প্রতিষ্ঠানে কাজ আবার শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ বাড়ল। কিন্তু এভাবে আমাদের কত দিন চলবে? প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সংসার চালাতে সমস্যায় পড়বে। সরকারের এদিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার ও কিছু আর্থিক সাহায্য করা প্রয়োজন।"
একই খেদ মনজুর হোসেন পিন্টু 'অঙ্কুর' মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠানের মালিকের গলায়। তিনি বলেন, 'আমি চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী এনে চিকিৎসা সেবা প্রদান করি। রিকভারী, চিকিৎসক ও কাউন্সিলরসহ ২২ জন স্টাফ আছেন। এই অবস্থা চললে এরা সবাই বেকার হয়ে পড়বে। এদের এখনো বেতন ভাতা দিতে পারছি, কিন্তু এটা কতদিন সম্ভব।'
এই প্রতিষ্ঠান গুলো দেশের মাদক চিকিৎসায় বড় ভূমিকা পালন করে। রোগী ভর্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে দেশের লাইসেন্স প্রাপ্ত তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসার পাশাপাশি এদের ভূমিকা আছে দেশের অর্থনীতিও। দুশ্চিন্তার মেঘ প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সবার মনেও। দেশে 'লকডাউন উঠে গেলেও প্রতিষ্ঠানগুলো তার পুরাতন ছন্দে ফিরতে পারবে কী?' এমন প্রশ্ন সবার। সকলে অপেক্ষায় আছে, কবে ফের প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু হবে?
লকডাউনে প্রবল সঙ্কটের মুখে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে দাঁড়ানো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উচিত, সম্প্রতি সংযোগ (মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের নেটওয়ার্ক)-এর অনলাইন সভায় বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথা উঠে এসেছে। তারা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কাছে দাবি করেন- মাদকাসক্তি চিকিৎসায় কর্মরতদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) প্রদান, লাইসেন্স ফি মওকুফ করা, সহজ শর্তে ও সুদ মুক্ত ঋণী প্রদান, রোগী প্রতি খরচ বা বরাদ্দ প্রদান, বিভিন্ন স্থান থেকে আনা-নেয়ার সুবিধা প্রদান, বিশেষ অনুদান প্রদান বা ইতোমধ্যে যারা অনুদান পেয়েছেন তাঁদের অর্থ অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠানোর দাবি তুলেছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে বাংলাদেশের মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র সাথে কর্মরত সকল পেশাজীবীদের কর্মসংস্থান রক্ষা করা আবশ্যক। কারণ এই পেশাজীবীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কাজ করেন। এদের জন্য কোন আর্থিক প্রণোদনা নেই।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব উত্তরণে পাঁচটি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মহামারী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত এই অর্থনৈতিক মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রর পেশাজীবীদের পাশে দাঁড়ানো এবং সহযোগিতার হাত বাড়ানো।
লেখক: ইকবাল মাসুদ, সভাপতি, সংযোগ; মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের নেটওয়ার্ক
ইত্তেফাক/আরএ