মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

তুরস্ক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যেখানে এসে মিশে গেছে

আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:০৯

বর্তমান বিশ্বে নানা কারণে তুরস্কের অবস্থান বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ, এসবের মধ্যে রয়েছে বিশ্বপর্যটনে দেশটির নেতৃত্বপূর্ণ অবস্হান। জিএমটিআই বা গ্লোবাল মুসলিম ট্রাভেল ইনডেক্স অনুযায়ী পৃথিবীর শীর্ষ মুসলিম পর্যটনপ্রধান দেশের তালিকায় তুরস্ক অন্যতম।

তুরস্ক এমন এক দেশ যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, তাদের ইতিহাস-শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ ভৌগোলিকভাবেও একসঙ্গে মিশে গেছে। বিশেষত এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগকারী দেশরূপে এক অনন্য অবস্হানে থাকা তুরস্ক বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রিয় ও পছন্দের ভ্রমণগন্তব্যরূপে ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কোভিডকালীন পর্যটনেও বিশ্বে নেতৃত্বস্হানীয় অবস্হানে থাকা তুরস্কের অবস্হান আগামীতে আরও সুসংহত হবে। বিশেষ করে তাদের সর্বোচ্চ সংখ্যক সেফটি স্টিকারিং অর্জনের কারণে—এমনই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে।

বাংলাদেশ ও তুরস্ক দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় চমৎকার এবং বহুমাত্রিক। উভয় দেশের মধ্যে পর্যটনবন্ধন এই সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

তুর্কি সভ্যতা অতি প্রাচীন সভ্যতা। ঐতিহাসিক বহু চরিত্র আর ঘটনার সমাবেশ সেখানে। রোমান, লাতিন, বাইজেনটাইন আর অটোমান সাম্রাজ্য প্রায় ১৬ শ’ বছর ধরে এই দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পদচারণা এখানেই ঘটেছিল। এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর ইউরোপের আধুনিকতা—এই দুইয়ের মিশেলে গড়ে উঠেছে তুরস্কের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সেরা প্রকাশ ইস্তাম্বুল শহর। ইস্তাম্বুলকে বলা হয়, ‘ইউরোপিয়ান ক্যাপিটাল অফ কালচার’। ইস্তাম্বুল তুরস্কের রাজধানী না হলেও সবচেয়ে বড় শহর এবং দেশের অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং সংস্কৃতির পীঠস্হান। ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণসাগর ঘিরে রেখেছে এই শহরকে। রেল চলাচলের মাধ্যমে এই শহর ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যুক্ত। টুরিস্ট স্পট হিসেবে ইস্তাম্বুল দারুণ জনপ্রিয়। শহরের প্রধান আকর্ষণ এর ঐতিহাসিক স্হানগুলো।

কীভাবে যাবেন?

ঢাকা থেকে টার্কিশ এয়ার সপ্তাহে ১২টি সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। টার্কিশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও, কাতার, এমিরেটস, কুয়েত এয়ারে ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করা যায়। সবক্ষেত্রে প্লেন ভাড়া প্রায় সমান। তবে যাদের সাথে শিশু বা ইনফ্যান্ট ভ্রমণ করবেন তারা শিশুদের টিকেটের বিষয়টি যাচাই করে নিলে ভালো। সাধারণভাবে যেকোনো এয়ারলাইন্স দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নামমাত্র টিকেট চার্জ করে থাকে, যার পরিমাণ এডাল্ট টিকেটের দশ ভাগ। আর শিশুর বয়স দুই বছরের বেশি এবং ১২ বছরের কম হলে তাদের জন্য শতকরা ৭৫ ভাগ। কিন্তু ইদানিংকালে কোনো কোনো এয়ারলাইন্স ইনফ্যান্ট টিকেটের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে না। তখন কোলের শিশুর জন্যও টিকেট বাবদ শতভাগ মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল রিটার্ন টিকেটের মূল্য ৭৫ থেকে ৯০ হাজার টাকার মধ্যে।

ভিসা

বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের তুরস্কে ভ্রমণের জন্য কোনো ভিসা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা ৯০ দিনের অন এরাইভাল ভিসা এয়ারপোর্ট থেকেই পাবেন। যারা টিপটপ ঝামেলাহীন ভ্রমণ পছন্দ করেন সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে ভিসা করে যাওয়া ভালো। তুরস্কের ভিসা পাওয়ার জন্য ৫/৭ ওয়ার্কিং ডে প্রয়োজন হয়। তুরস্কের ভিসার পাওয়ার জন্য অ্যাম্বাসির অনুমোদিত ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টার রয়েছে।

কোথায় থাকবেন

ইস্তাম্বুলে থাকার জন্য অসংখ্য হোটেল রয়েছে। বাজেট হোটেল থেকে স্টার সবরকম ব্যবস্হা রয়েছে। গড়ে ৫০ ইউএস ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ ডলার প্রতি রাতের জন্য ভাড়া হতে পারে। এগুলো স্টান্ডার্ড এবং তুলনামূলক নিরাপদ। তুরস্কের মুদ্রার নাম টার্কিশ লিরা। আমেরিকান ডলারের সাথে এক্সচেঞ্জ রেট স্বাভাবিক সময়ে ১ ডলার সমান প্রায় তিন/চার লিরা (মুদ্রাস্ফিতির কারণে এখন বড় তারতম্য ঘটেছে, যা প্রায় ১৪ লিরা)। সাধারণত টু স্টার বা তদুর্ধ্ব হোটেলগুলোতে রুম ভাড়ার সাথে ব্রেকফাস্ট ইনক্লুড করা থাকে। রুমে চা-কফি এবং মিনারেল ওয়াটারও থাকে।

সতর্কতা

যেকোনো টুরিস্ট সিটির মতো ইস্তাম্বুলেও নানারকম প্রতারকচক্র সক্রিয়। সেজন্য নেহাত সস্তার লোভে যেকোনো জায়গায় যেকোনো হোটেলে না থাকাটা নিরাপদ। যাতায়াতের জন্য শহরে বাস, ট্রেন ও কার রয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়ানস্টপ সার্ভিস পেতে বিভিন্ন সহায়ক প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে।

দর্শনীয় স্থান

১. এশিয়া আর ইউরোপকে সংযোগকারি ১৯৫৭ সালে নির্মিত বিশাল লম্বা সেতু। বসফরাস জলবিহারে অবশ্যই দেখে নিতে হবে এই সংযোগকারী সেতুটি। ২. সমুদ্রপ্রেমীদের জন্য ‘গোল্ডেন হর্ন’। আমোদ-প্রমোদের এক চোখ ধাঁধানো আয়োজন। ৩. তোপকাপি প্যালেস। এটা অটোমান সুলতানের প্রাসাদ। ইতিহাস যেন কথা বলে এই প্রাসাদে। ৪. হাগিয়া সোফিয়া। বর্তমানে মসজিদ। এটি একটি সংগ্রহশালা বা জাদুঘরও। বারবার পুড়েছে আবার তা পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। ৫. ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত নীল মসজিদ। অটোমান সুলতান প্রথম আহমেদের তৈরি এই নীল মসজিদ। নীল টাইলস আর নীল অন্দরসাজের কারুকাজ দেখার মতো। ৬. চানাক্কালে। ইস্তাম্বুল থেকে দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। চানাক্কালের সেরা আকর্ষণ চার হাজার বছরের প্রাচীন শহর ট্রয়। রূপকথার শহর। হোমারের ইলিয়ড আর ওডিসি থেকে উঠে আসা এ শহরকে ঘুরে দেখলে ইতিহাসকে যেন স্পর্শ করা যায়। চানাক্কালে যাওয়ার পথে দেখা যেতে পারে আনজাক কোভ। দুই হাজার ফুট লম্বা একটি উপসাগরীয় খাঁড়ি। ৭. কাপাদোকিয়া। রোমাঞ্চকর বেলুন সফরে আকাশে উড়ে বেড়ানোর ব্যবস্হা রয়েছে এখানে। আরও রয়েছে ঐতিহাসিক নগরদুর্গ, কেমাকলি। এটি আছে মাটির তলায়। এই দুর্গের চারটি তলা পর্যটকরা দেখতে পারেন। রয়েছে অ্যাস্তানোস মৃত্শিল্পালয়। কার্পেটের কারখানাও রয়েছে। ৮. এখানেই শেষ নয়। তুরস্ক এমন এক দেশ, যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেড়ানোর নানা রোমান্টিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা জায়গা। এরমধ্যে ‘সিটি অফ প্রফেটস’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরকম আরও কয়েকটি স্হান— কুসাদাসি, কালচান, কেতি, কাস, অ্যাস্টালিস, পামুক্কাল, প্রাচীন শহর হিয়েরা পোলিস। ক্লিওপেট্রা সেতু, ঐতিহাসিক শহর এফেসুস। ৯. কুসাদাসি-শিশুদের দারুণ পছন্দের জায়গা। ১০. কাস : ভূমধ্যসাগরের পারে চমৎকার ‘হারবার সিটি’ লজ। ১১. কাপুটাস বিচ-সোনালি বালু ও অসম্ভব স্বচ্ছ জলের জন্য বিখ্যাত এই বিচ। ১২. কেতি দ্বীপ; যা ছবির মতো চমৎকার। সারা বছর টুরিস্টরা এখানে ভিড় করেন।

বছরের যেকোনো সময় তুরস্ক ভ্রমণ করা যায়। দেশটির আবহাওয়া চমৎকার, নাতিশীতোষ্ণ। ফলে খুব বেশি শীত বা গরম কোনো ভয় নেই। তুরস্ক ভ্রমণে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে পর্যটনবিষয়ক ম্যাগাজিন ভ্রমণ-এর তুরস্ক সংস্করণে।

(তথ্যসূত্র :টিআরডি, ট্রাভেল ম্যাগাজিন ভ্রমণ)

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন