শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিশুশ্রমিক আসিফ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র

'মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়'—কথাটিকে আরো একবার প্রমাণ করলেন আসিফ আলী। অভাবের সংসারে কখনো হয়েছেন হোটেল বয়, কখনো দোকানের কর্মচারী, আবার কখনোবা দিনমজুর। কিন্তু কোন কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ঢাবি, রাবি, জবি সহ আসিফ এবার সুযোগ পেয়েছেন দেশসেরা ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার জীবনযুদ্ধের গল্প শুনেছেন তানভীর তানিম

আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:২২

আসিফের ছেলেবেলা
প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর মা আবারও বিয়ে করেন। বাবারও এটা দ্বিতীয় বিয়ে। তিনি নেশা করতেন। একদিন মাকে মারধর করে বাসা থেকে চলে গেলেন। সেই থেকে নিরুদ্দেশ তিনি; তখন আসিফ ক্লাস থ্রি তে পড়েন। দাদা করতেন ইটভাঙার কাজ। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালে তিনিও মারা গেলেন। মা ধারদেনা করে একটা ছাগল কিনলেন। দাদি মরিচ, ডাল তুলে দেওয়ার বিনিময়ে কেজিপ্রতি ৫-১০ টাকা পেতেন। অভাব কি জিনিস তখনই হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে আসিফকে।


হোটেল বয়ের কাজ 
ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়ে পেটের দায়ে হোটেলে কাজ করা শুরু করেন। কাজ বলতে হোটেল বয়ের কাজ। দিনে ৫-১০ টাকা করে মজুরি, সাথে খাওয়া ফ্রি। গ্রামের মেম্বার তিন হাজার টাকার বিনিময়ে একটা কার্ড করে দিয়েছিলেন। ৩০ কেজি চাল পাওয়া যেত প্রতি মাসে। খরচ পড়ত কেজি প্রতি ১০ টাকা। কিন্তু সবজির সমস্যা থেকেই গেল। এমনও দিন গেছে, শুধু নুন দিয়ে ভাত খেতে হয়েছে। মানুষের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যদি একটু ভালো-মন্দ খেতে দেয়।

 

 

• বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় আসিফের ফলাফল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - ২৫৩২তম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় - ৬৯০তম
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় - ৬৭১তম
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় - ৬৬১তম
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা - ৬৪.৫০ নম্বর
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় - ২২৩তম


এরপর সবজির দোকানে
সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর গ্রামের এক চাচার সবজির দোকানে কাজ নিলেন। সকালে সেখানে গিয়ে স্কুলের সময় হলে চলে আসতেন। সপ্তাহে দুই দিন হাটবার—রবি আর বুধ। এই দুই দিন বাজারে ভিড় থাকায় স্কুলে যাওয়া মানা। হাটবারে দুই বেলা খাওয়া, ১০০ টাকা আর বাড়ির জন্য সবজি দিতেন। 
এদিকে প্রতিবছর ঝড়-বৃষ্টিতে ঘরের টিনের চালা উড়ে যেত আসিফদের। পানিতে তখন বই, কাপড়-চোপড় সবকিছু ভিজে একাকার হতো। এসবের মাঝেই এসএসসি পরীক্ষায় পেলেন জিপিএ ৪.৮৯।


স্বপ্ন দেখা শুরু
সবজির দোকানে কাজ করার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটাই ছিল আসিফের জীবনের মূল অনুপ্রেরণা। ঠিক সকাল ৮ টার দিকে মাহেন্দ্রা বাজারে বাসটি দেখতে পেতেন। দেখতেন দোকানের আশপাশ দিয়ে অনেক ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থী ব্যাগ কাঁধে বাসে উঠছে। এই ভালো লাগা আরও বাড়ে যখন ২০১৮ সালের পহেলা বৈশাখের দিন প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরতে যান।


ইউ আর ফাইনালি সিলেকটেড

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কলেজের এক বন্ধুর বাবা মারা গেলেন। জানাজায় অংশ নিতে আসিফ গেলেন জয়পুরহাটে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সাথে পরিচয় হয়। তার বাবা রিকশাচালক ছিলেন। ঘুড্ডি থেকে বৃত্তি পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি অনুপ্রেরণা দিয়ে বললেন, তুমিও পারবে আসিফ। তার থেকে জানলেন, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন একটা পরীক্ষা নেবে। চান্স পেলে ঢাকায় চার মাস থাকা-খাওয়াসহ ভর্তি কোচিং ফ্রি। রাজশাহীতে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে মনোনীত হন আসিফ। চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে যান ঢাকার মোহাম্মদপুরে। প্রশ্ন এত কঠিন হয়েছিল যে পরীক্ষার হলেই কেঁদে দেন। শেষপর্যন্ত সব ধাপ অতিক্রম করে ভাইভা দিয়ে ফেরার পথে এসএমএস পেলেন, ‘ইউ আর ফাইনালি সিলেকটেড।’


যত চমক
ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম পূরণের টাকা দিয়েছিল মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। সর্বমোট পাঁচ হাজার টাকা। বিইউপি, ঢাবি, রাবি, গুচ্ছতে শুধু পরীক্ষা দিলেন। গাড়ি ভাড়া না থাকায় আবেদন করেও জাবি আর চবিতে যাওয়া হলো না। ফলাফল বের হলো। ঢাকা, বিইউপি, রাজশাহী, জগন্নাথ, খুলনা, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হলেন। ভর্তি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এ, সেখানে ৭০০০ টাকার পুরোটাই দিল ঘুড্ডি। কিন্তু রাজধানী কেন্দ্রিক জীবনযাপনের ইচ্ছায় পরবর্তীতে জগন্নাথে চলে আসেন। ভর্তি হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। এখানে ভর্তির টাকাও দিয়েছিল মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

 

আসিফ আলীর বর্তমান
বর্ণতে কোচিং করার সময় পরিচালকের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়। ভালো ফলাফলের জন্য তাকে পছন্দ করতেন তিনি। দুশ্চিন্তা করতে দেখলে সাহস দিতেন। বর্তমানে সেই কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া, কাউন্সিলিং, খাতা নিরীক্ষণ করার কাজ করছেন আসিফ। পাশাপাশি হাতখরচ চালাতে ‘রাজশাহী পিউর ফুড’ নামের একটা পেজ চালু করেছেন। সেখান থেকে স্বল্পমূল্যে রাজশাহীর আম, গুড় সরবরাহ করেন। আপাতত পড়াশোনার পাশাপাশি এভাবেই চলছে।

ইত্তেফাক/এসজেড/এসটিএম