৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে ঠিক হয় আশার। বয়স তখন মাত্র ১১। এ বয়সে বিবাহ আইনত অপরাধ—জানা ছিল তার। তাই নিজেই করলেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ। শিক্ষকদের সহায়তায় কৌশল অবলম্বন করে বন্ধের চেষ্টা করলেন বিয়ে। প্রথমদিকে তেমন ফলপ্রসূ না হলেও আশা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় এক পর্যায়ে নমনীয় হতে হয় পরিবারকে। বন্ধ হয় সেই বিয়ের আয়োজন। তবে পরিবার সাফ জানিয়ে দেয় তার পড়াশোনার আর কোন খরচ বহন করা হবে না। কিন্তু সাহসী আশা দমবার পাত্র নন। ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে জোগাড় করা অর্থ দিয়ে চালিয়ে নেন নিজের পড়াশোনার খরচ। পাশাপাশি অসহায় ও হতদরিদ্র নারীদেরকে নিয়ে শুরু করেন ‘আসমানী যুব নারী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন।
আশার পুরো নাম শিরিন আক্তার আশা। জন্ম নীলফামারীতে। বর্তমানে লেখাপড়া করছেন নীলফামারী মশিউর রহমান ডিগ্রী কলেজে, অনার্স ৩য় বর্ষে। ছোটবেলায় নিজের বাল্যবিবাহ চেষ্টার এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা একসময় দারুণ ভাবিয়ে তোলে আশাকে। বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার জোরে তিনি নিজে হয়তো বেঁচে গেছেন, কিন্তু অনেকের ভাগ্যে এমনটা হয় না; পরিবার-পারিপার্শ্বিকতার জেরে অনেক ছোটবেলাতেই বলি হতে হয় বাল্যবিবাহের। তাই দরকার এমন একটি প্লাটফর্ম বা সংগঠনের, যা কিশোরীদেরকে বাল্যবিবাহ থেকে বাঁচাবে আবার অসহায় নির্যাতিত নারীদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলতেও সাহায্য করবে। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম আসমানী যুব নারী ফাউন্ডেশনের।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত ২৯৪টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে সংগঠনটি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে ৩৬জন নারী উদ্যোক্তা তৈরি করেছে আর অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি করেছে আসমানী স্যানিটারী ন্যাপকিন কারখানা। আশা বেশি গুরুত্ব দেন ১৫-৩৫ বছরের মেয়েদের প্রতি। কারণ সমাজে এই বয়েসের নারীরাই বেশি সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। তাই তাদেরকে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কাজ শুরু করেন। নিয়মিত উঠান বৈঠক, বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন ও পরিচর্যা সম্পর্কিত কর্মশালা ও দক্ষতা বৃদ্ধি বিষয়ক সভা সেমিনারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস দূরীকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এসব কাজে স্বীকৃতিও মিলেছে বেশকিছু। মেয়েদের সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে কাজ করায় ২০১৪ সালে স্পেনের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি হিসেবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান আশা। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসাবে ‘জয়িতা’ অ্যাওয়ার্ড মেলে ২০১৯ সালে। আর গত বছর পেয়েছেন ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২১’।
আশা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন; স্বপ্ন দেখাতেও ভালোবাসেন। আশার তৈরি করা ‘আসমানী স্যানিটারী ন্যাপকিন’ কারখানায় কাজ করে জীবনকে নতুন করে সাজিয়েছেন ১০০ জন নির্যাতিত, অবহেলিত ও দরিদ্র নারী। সুতি কাপড় দিয়ে তৈরি করা স্যানিটারী ন্যাপকিন ও মাস্ক নিজেরাই বাজার জাত করেন। বিতরণ করেন স্বল্পমূল্যে। মহামারী করোনায় নিজেদের তৈরি মাস্ক, সেনিটাইজার ও স্যানিটারী ন্যাপকিন বিলিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষের মাঝে।
ইত্তেফাককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আশা বলেন, ‘আমরা কিশোরী ও অসহায় নারীদেরকে নিয়ে কাজ করছি। স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছি। সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ করছি, আবার নিজেদের কারখানার মাধ্যমে সেসব নারীদেরকে কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছি। বর্তমানে আমাদের কাজের ক্ষেত্র ছোট, তবে ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত পরিসরে কাজ করতে চাই।'