শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

প্রাকৃতিক উপকরণে ঘর তৈরির ব্যতিক্রমী কর্মশালা

আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:২১

সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই) ভবন প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হলো ভিন্নধরনের এক কর্মশালা। বাস্থই-এর সবুজ উঠোনজুড়ে একদল তরুণীকে দলবেঁধে কাজ করতে দেখা গেল। নানা আকৃতিতে বাঁশ কেটে সাজিয়ে রাখছেন তাদের কেউ কেউ। কেউ ব্যস্ত বেতের পাটিতে নানারকম চিত্রকর্ম তৈরিতে। কাউকে দেখা গেল বাঁশে দড়ি বেঁধে তৈরি করছেন ঘরের কাঠামো।

এই তরুণীরা আসলে কী করছেন— প্রথম দেখায় হয়তো খানিকটা বিভ্রান্ত হতে পারতেন যে কেউ। পরে জানা গেল, এদের সবাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী। কয়েকজন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক পাট চুকিয়ে পা রেখেছেন স্থাপত্য পেশায়। প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে কম খরচে পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা। ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর ট্র্যাডিশনাল বিল্ডিং, আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজম; ব্রিটিশ কাউন্সিল, বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্কিটেকচার অ্যান্ড ডিজাইন ও ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিটেকচার যৌথভাবে এই কর্মশালা আয়োজন করেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'ব্যাম্বু ট্রেনিং ওয়ার্কশপ'।

চলছে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ। বাঁশের কাঠামো দাঁড় করাতে কাজ করছেন এই তিন শিক্ষার্থী। ছবি: সংগৃহীত

গত ১৮, ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি বাস্থই প্রাঙ্গণে চলে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শুরু হয় আরও তিনদিনব্যাপী কর্মশালা। এদিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় শুরুতেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটি গেয়ে। পরে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। উদ্দেশ্য, এবার প্রশিক্ষণে শেখা পদ্ধতি অনুসারে বাঁশের ঘর তৈরি করবেন শিক্ষার্থীরা।

ঘরের প্রোটোটাইপ। ছবি: সংগৃহীত

কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, এ ধরনের আয়োজনের পেছনে রয়েছেন পাকিস্তানের প্রথম নারী স্থপতি ইয়াসমিন লারি। গত তিন দশক ধরে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদেরকে কম খরচে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে ঘর তৈরি করতে শেখাচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারীদেরকে সাশ্রয়ী উপায়ে জীবনধারণের নানা পদ্ধতি শেখান লারি। পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা এ স্থাপনাগুলো লারির নামেই 'লারি অক্টাগ্রিন' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের হবু ও নবীন স্থপতিরাও তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

মডেল দেখছেন শিক্ষার্থীরা। বাঁশ ব্যবহার করে অনুরূপ একটি স্থাপনা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই। ছবি: সংগৃহীত

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন স্থপতি অধ্যাপক ড. জয়নাব ফারুকী আলীকেও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এ ধরনের ধারণা নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন স্থপতি লারি। অধ্যাপক জয়নাবও এতে আগ্রহী হন। শিক্ষার্থীদের মাঝেও খবরটি ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত। পরে কয়েক দফা ভার্চুয়াল সেশনে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন ইয়াসমিন লারি।

অধ্যাপক জয়নাব ফারুকী আলীর নেতৃত্বে এই কর্মশালায় যুক্ত আছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইকা ইকবাল মেঘনা, দিলরুবা ফেরদৌস শুভ্রা, তানজিনা খান, প্রভাষক শায়কা বিনতে আলম, ইম্মাত আরা এমা, নাবিলা নুশাইরা ও তারান্নুম মাহমুদ সহ আরও অনেকে। এছাড়া আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থীও এতে অংশ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন প্রাকৃতিক উপাদানের বাড়ির ছোট কয়েকটি মডেল। শেষ তিনদিনের কর্মশালায় তারা তৈরি করছেন আস্ত বাড়ি। বাঁশ ও বেত ব্যবহার করে তৈরি করা ঘরটিতে রান্নাঘর ও শৌচাগারও থাকবে। মূল কাঠামো বাঁশের হলেও দেয়ালে থাকবে বেত। আর রঙতুলির আঁচড়ে বেতের গায়ে আঁকা হচ্ছে নারীর অবয়ব সহ নানারকম ছবি।

বেতের প্যানেলের উপর নানারকম ছবি আঁকছেন এই হবু স্থপতিরা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে এই কর্মশালা চলার প্রায় একইসময়ে পাকিস্তানেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন আরেকটি কর্মশালা। পাকিস্তানের হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এটি আয়োজন করেছে। ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে দুটিই প্রচার করা হচ্ছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্কিটেকচার অ্যান্ড ডিজাইনের পেজে

কর্মশালা শেষে মার্চে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অর্থায়নে বাংলাদেশ থেকে ছয়জনের একটি দল লন্ডন যাবে। সেখানে পাকিস্তান থেকে আসা ছয়জন ও ব্রিটিশ ছয়জন নারীর দুটি দলও অংশ নেবে। বাঁশ ও বেতের প্যানেল ব্যবহার করে ঘর তৈরি করবেন তারা। জানা গেছে, কিংস ক্রস স্টেশনে এবারের মতোই মাত্র তিনদিন সময়ে একটি মডেল ঘর তৈরি করা হবে। তবে দেয়ালে বাঁশ বা বেতের পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে বাংলাদেশের ঐতিহ্য নকশিকাঁথা। স্টেশনে প্রদর্শনী শেষে মডেলটি স্থানান্তর করা হবে ওয়েলসে। সেখানে প্রিন্স চার্লসের বাসভবনে প্রদর্শনীর পাশাপাশি স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হবে ঘরটি।

বাঁশ দিয়ে মূল স্থাপনা তৈরির আগে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা কয়েকটি মডেল। ছবি: সংগৃহীত

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক জয়নাব ফারুকী আলী বলেন, ‘সম্প্রতি দুইদশক পেরিয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মানবিক ও পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরিতে উৎসাহ দিয়ে আসছি। বাঁশ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে ঘর তৈরি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। ফলে এতে কোনো কার্বন নিঃসরণ হয় না। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের স্থপতিদেরকে এ ধরনের কাজে আরও উৎসাহ দিতে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এই কর্মশালায় যোগ দিয়েছে। এ ধরনের পরিবেশবান্ধব স্থাপনা প্রয়োজনমতো নানা কাজে ব্যবহার করা যাবে। যেমন, দরিদ্র বা সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নারীদের জন্য স্বল্প খরচে এমন ঘর তৈরি করা হলে তারা এর ভেতর বসে পোশাক বানাতে পারবেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। সেলাই শেখার স্থান হিসেবে, আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবেও এধরনের ঘর ব্যবহার করা যাবে। ঘরগুলোর আয়ুষ্কাল হবে ১৫ থেকে ২০ বছর। প্রয়োজন অনুসারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরও করা যাবে।’

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন