শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভাষাপ্রেম না কি মাছের মায়ের পুত্রশোক?

আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২২, ০৩:৪৬

‘মা দেখো কী সুন্দর আকাশ। কী বলছ এসব বেবি? তোমাকে না বলেছি ইংরেজিতে কথা বলবে? ও স্যরি মাম। মাম লুক, হোয়াট অ্যা বিউটিফুল স্কাই।’

বিরল এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছি আমরা। মায়ের ভাষার জন্য লড়াই করেছি। বুক পেতে দিয়েছি অস্ত্রের সামনে। যে কীর্তি গড়েছি শুধু আমরাই। 

ভাষা আন্দোলন। ভাষার জন্য লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনেছি আমরা, ১৯৫২ সালে। ভাষার লড়াইকে সম্মান জানিয়েছে বিশ্ববাসীও। ১৯৫২ থেকে ২০২২, ৭০ বছরে ভাষার ব্যবহার এসে ঠেকেছে তলানিতে। পাশ্চাত্যের মিশেলে আমরা ভাষার ব্যবহারকে নিয়ে গেছি লজ্জাজনক অবস্থায়। আর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি নিজেদের। ভাষার প্রতি ভালোবাসাটা যে ঠেকেছে শুধুমাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনটায়। দুর্ভাগ্য এখানেই।  আমাদের এই ভাষাপ্রেম যেন মাছের মায়ের পুত্রশোক।

সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে বিশ্ব। উন্নত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। বদল ঘটেছে সমাজব্যবস্থার। আর সেই সঙ্গে বদলেছে ভাষার ব্যবহার। অভিভাবকরা সন্তানকে তথাকথিত সুশিক্ষিত করবার আশায় পড়াচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যমে। তারা পড়ছে ইংরেজি ভাষা। সঙ্গে ভুলতে বসেছে বাংলাটা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। সে ভাষাই এখন অনেকের আয়ত্তে নেই।

অঞ্চলভিত্তিক ভাষার ব্যবহার ভিন্ন। আর আঞ্চলিকতা বাঙালির শিরায় শিরায়। কিন্তু আঞ্চলিকতায় কথা বলাও এখন দায়। আঞ্চলিক ভাষা নিজ অঞ্চলেও দিনকে দিন বেমানান হয়ে উঠছে। অন্য কোথাও বললেই হতে হয় হাসির পাত্র।

বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আমরা জ্ঞান অর্জন করে শিক্ষিত হচ্ছি। কিন্তু ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা কতটুকু রাখতে পারছি? আত্মত্যাগ, কষ্টে অর্জিত এই ভাষায় মূল্য কোথায়?

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা  করা যেমন কঠিন, ঠিক তেমনই কঠিন বড় কোনো অর্জনের পর সেটি যথাযথ মর্যাদায় রক্ষা করা। চাকরি পরীক্ষার সাক্ষাৎকার কিংবা ভর্তি পরীক্ষা সবার চাই ইংরেজিতে দক্ষতা। বাংলার প্রাধান্য যেন নেই বললেই চলে। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের অহংকারের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ভাষা আন্দোলন। ইংরেজি দক্ষতার প্রয়োজন আছে তাই বলে মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা করে নয়।

তথ্যমতে, বিশ্বে ৩০ কোটি মানুষ কথা বলেন বাংলা ভাষায়৷ বিশ্বের ছয় হাজার থেকে আট হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা পঞ্চম স্থানে। এ যেন কাজীর গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। মর্যাদা আছে, আছে সংখ্যার আধিক্য। কিন্তু ব্যবহারটা যে ঠুনকো। অন্য ভাষা মিশিয়ে অদ্ভুতভাবে উপস্থাপন করাই যেন আধুনিকতা। আমার শপিং করতে খুব ভালো লাগে, চল ট্রুরে যাই, এসাইনমেন্ট করি, আজ ডিনার বাইরে করব কিংবা খাবারটা খুব ইয়াম্মি। এসব যেন নিত্যদিনের কথামালায় পরিণত হয়েছে। আবার চটজলদি ইংরেজি কপচানো অনেককেই দেখবেন সাবলীল ইংরেজিতে কথা বলতে অপারগ। ভাষা জানাটা মন্দ নয় বরং প্রশংসনীয়। কিন্তু নিজের ভাষাকে খুন করে নয়। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার করা ভাষা নিয়ে আলোচনা করাই যেন দায়। আর প্রচার-প্রচারণায়  ইংরেজি যেন না হলেই নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা ভাষার প্রয়োজনটা কি? কথায় আছে, মা গরিব হলেও আপন। মায়ের কাছেইতো আমরা আজীবন শিশুর মতো যত্ন পাই। মা রেখে কেনই বা মাসির দরদকে গায়ে মাখব? হ্যাঁ মাখব, তবে মাকে আপন ও সর্বোচ্চ স্থানে রেখে। বাংলা আমাদের পরিচয়। আর পরিচয়হীন মানুষের গুরুত্ব কতোটা তা হাড়ে হাড়ে টের পান পরিচয়হীনরা।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার নিজ দেশ ও সংস্কৃতি ভুলে পশ্চিমাপ্রেমি হয়ে উঠেছিলেন। একটা সময় হাঁপিয়ে যান তিনি। কিন্তু খুব দ্রুতই তার বোধোদয় হয় এবং বাকি জীবন তিনি নিজ সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় কাটিয়ে দেন। আমাদেরও হাঁপিয়ে উঠার আগে চাই
সচেতন হওয়া। চাই ভাষার সুষ্ঠু ব্যবহার। 

আমি বলছি না অন্য দেশের ভাষা কিংবা সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা না করতে কিংবা আয়ত্তে না রাখতে। বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও জ্ঞান রাখতে হবে। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরে এসেও আমরা বাংলায় সমৃদ্ধ নই। এটা মানা যায়? আজো বাঙ্গালির তৃপ্তির খাবার ভাত। তৃপ্তি পান মাছে। তবে এই বার্গার কিংবা পিজ্জাকে ভাতের সঙ্গে কেন মিশিয়ে ফেলা?

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন