সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

'৫২ থেকে ২২' আত্মত্যাগের ইতিহাস

আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২২, ০৩:৪৮

মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন হলেও দীর্ঘ ২৩ বছর আন্দোলন সংগ্রামের পর পৃথিবীর ভূখণ্ডে স্থান করে নেয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে ভাষার জন্য জীবন দেওয়া দেশ হলো বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময় যুদ্ধ-বিগ্রহ পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানো যখন অসম্ভব ছিল সেখান থেকে ৫০ বছরে প্রাপ্যতার হার বৃদ্ধি হওয়ায় বিশ্ব দরবারে পরিচিত হয়েছে ভিন্নভাবে।

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান আবার বিভক্ত হয় দুইটি নামে(পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান)। দেশ ভাগে সমস্যা না থাকলেও পাকিস্তানের জন্মের সাত মাসের মাথায়, ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন- “Urdu and only urdu shall be the state language of Pakistan”।  তিনি হয়তো ভাবেন নি যে, তার উচ্চারিত কিছু কথা একসময় তারই প্রতিষ্ঠিত নুতন দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে ভূমিকা রাখবে। জিন্নাহর এই বক্তব্য তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং এর আহবায়ক ছিলেন আবদুল মতিন। 

অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মায়ের মুখের ভাষার রক্ষার জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ করেন।এতে ঘটনাস্থলে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ ও আব্দুর জব্বার মৃত্যুবরণ করেন এবং হাসপাতালে মারা যান আব্দুস সালাম। এই ঘটনার পরবর্তী সময়ে বাঙ্গালিরা বুঝতে পারে তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে জিম্মি হতে শুরু করেছে।

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেটের পাশে অস্থায়ীভাবে স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়।ঐদিন পাকিস্তান সরকার সকল ধরণের সভা সমাবেশ বন্ধ করায় প্রতিবাদস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শোকের প্রতীক হিসাবে কালো ব্যাজ ধারণ করেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯ টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পেয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। পরবর্তীতে প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহণ করলেও মাত্র আড়ায় মাসের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও  একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হয়।

১৯৬০ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয় শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট, যা ১৯৬২ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু বিভিন্ন দিক থেকে বৈষম্যমূলক বলে ওই শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলো। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্র সংগঠনগুলো হরতালের ডাক দিলে ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে ঢাকার হাইকোর্টের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুনরায় গুলি চালায় পুলিশ এবং নিহত হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা এবং বাবুল। হত্যার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় বেগমান হতে থাকে সকল আন্দোলন।

পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক,অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক শোষণ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। কিন্তু তা গৃহীত হয়নি। তবে তারা থেমে থাকেনি, চলমান রাখে তাদের আন্দোলন।

আন্দোলন বানচাল করার উদ্দেশ্যে ৩রা জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে দায়ের করা হয় এক মিথ্যা মামলা। যা আগরতলা মামলা নামে পরিচিত।মূলত আন্দোলনকারীদের মূলদেরকে লক্ষ্য করে করা হয় এই মামলা। আসামী করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ ৩৫ জনকে। ৬ই জানুয়ারি ১৯৬৮, গ্রেফতার করা হয় ২৮ জনকে। পরবর্তীতে তাদের রাষ্টদ্রোহী মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও 'আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়। কিন্তু ১৫ই ফেব্রুয়ারি প্রহরীর গুলিতে নিহত হন সার্জেন্ট জহুরুল।

অবশেষে ০৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পুণরায় ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু হয় তাল-বাহনা। ক্ষিপ্ত হতে থাকে পূর্ব বাংলার জনগণ। দেশের কথা বিবেচনা করে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৮ মিনিট ব্যাপী ভাষণ দেন। ভাষণে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, সেখানেই শেখ মুজিব বলেছিলেন, "এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এর পরবর্তীতে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, নাম দেওয়া হয় অপারেশন সার্চলাইট। ওই রাতেই গ্রেফতার করা হয় স্বাধীনতার ঘোষক শেখ মুজিবর রহমানকে।

২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালের সন্ধ্যা ৭:৪০ মিনিটে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর লিখিত ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান এবং পরদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রাতের অধিবেশনে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে লিখিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।

শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ব্যক্তিদের যুদ্ধ, নারীদের সাহায্য আর ইজ্জত, ত্রিশ লক্ষ শহিদ আর দুই লক্ষ নারীদের আত্মসম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর ভূখণ্ডে জন্ম নেয় এক স্বাধীন রাষ্ট্র।

স্বাধীনদেশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়।

কিন্তু বাংলার ইতিহাসে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয় ১৯৭৫ সালে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ তার পরিবারের প্রায় সকলকে খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে একদল সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হতে হয়। আর ৪ঠা নভেম্বর জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় ৪ নেতাকে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের সংস্কৃতিতে আসে পরিবর্তন। গণজাগরণের মাধ্যমে আধা-সামরিক ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের হটিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত লেগে যায়।  তবে ১৯৯১ সালের পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিকভাবে চলে আসছে নির্বাচন এবং সরকার গঠন। তবে, এটাও বলা উচিৎ যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তার উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ যে সংশোধনীগুলো এনেছিলেন, তা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে গভীরভাবে ক্ষতি মুখে পতিত করা সত্ত্বেও পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলো সংবিধানের এই দিকগুলোতে নজর দেয়নি। জাতি গঠনের অন্যতম প্রাথমিক ভিত্তি থেকে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে সরে যাওয়ার এই দুঃখজনক গল্প একটা বিষয়কেই প্রকাশ করছে, যেটা হচ্ছে 'প্রগতিশীলতার পথে কয়েক ধাপ আগানো এবং মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে বেশ কয়েক পা পেছন হটা। যেন একটি পা সামনে আগাচ্ছে এবং অন্যটি পেছনের দিকে, আর এই দোটানার মধ্যে থেকে ক্রমশ সারা শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্নও হচ্ছে বটে। 

আজকের মৌলবাদ ও অসহিষ্ণুতার উত্থানের পেছনে অগণতান্ত্রিক ও ভিন্নমত দমনের রাজনীতিই সরাসরি দায়ী, যে রাজনীতি ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতাকারী সব ব্যক্তি ও সংগঠনকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এই প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে সরকারকে তার সব মিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করছে এবং ক্রমশ আমলাতন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও পেশী শক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে।

দেশের কথা চিন্তা করে হলেও জনমানুষের ভেতরে প্রয়োজন সংহতি, বিশেষ করে রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, তরুণ, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং সকল বিশ্বাস ও মতাদর্শের মানুষের মধ্যে। সারা দেশ জুড়ে একটি গণসচেতনতামূলক প্রচার চালানো দরকার।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন