ঘড়ির কাটায় রাত আড়াইটা। মধ্যবয়সী এক নারী মানসিক যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারছেন না। সংসারে পারিবারিক কলহ আগে থেকেই ছিল, সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। ছোটবোন তাকে তেমন কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ অনেকগুলো অপমানজনক কথা শুনিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি স্তব্ধ। এই অপমান নিয়ে আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, এমনটা ভেবে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চাইলেন। হাতের মুঠোয় তুলে নিলেন ঘুমের ওষুধ। ঠিক তখন মনে হলো, এমন কেউ যদি পাশে থাকতো যে তার মনের কথাগুলো শুনবে, একটু পাশে থাকবে... ভাবতে ভাবতে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা গ্রুপ 'প্রিয় ক্যামেলিয়া'-তে তিনি লিখে ফেললেন, 'কেউ কি আছেন যিনি আমার কথা শুনবেন? আমি আর পারছি না। আমার সাহায্য দরকার।'
লেখাটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রুপের ভলান্টিয়ার টিম ওই নারীর মেসেঞ্জারে ক্ষুদে বার্তা পাঠায়, 'আপু, আমরা আছি। আপনি কি আমাদের সাথে আলাপ করতে চান? মেসেঞ্জারে কল করছি। অনুগ্রহ করে রিসিভ করবেন।'
এরপর ঘন্টাখানেক ধরে ওই নারী তার মনের জমানো দুঃখ বলে ফেলেন। আলাপ শেষ করে উনি বুঝতে পারেন জীবনে ঝড় আসবে এবং এই ঝড়ে হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। ঘুরে দাড়াতে হয় আর এই যাত্রায় ওনার সঙ্গী হয়ে থাকছে, প্রিয় ক্যামেলিয়া টিম। উনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেই রাতে প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিলেন।
ব্যস্ততায় ডুবে থাকা এই নগরীতে যখন কারোরই সময় নেই পাশের মানুষটির কথা শোনার বা তাকে বোঝার, তখন বন্ধু হয়ে হাজারো মানুষের কথা শুনছে 'প্রিয় ক্যামেলিয়া'। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে মানসিক সহায়তামূলক এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি যাত্রা শুরু করে। শুরুতে অল্পকয়েকজন সদস্য থাকলেও বর্তমানে গ্রুপটির সদস্য-সংখ্যা ৪২ হাজার ছাড়িয়েছে।
'প্রিয় ক্যামেলিয়া' মূলত একটি মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানকারী। এর প্রতিষ্ঠাতা সুইডেন প্রবাসী ক্যামেলিয়া কামাল। ফড়িং ক্যামেলিয়া নামে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত। খুব কাছের এক বন্ধুর আত্মহত্যার ঘটনা গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলো তাকে, সেই অনুভূতির সূত্র ধরেই আজকের তিনি গড়ে তুলেছেন 'প্রিয় ক্যামেলিয়া' নামের প্ল্যাটফর্ম।
ফেসবুক গ্রুপ, পেজ, ইমেইল, ম্যাসেঞ্জার কলের মাধ্যমে বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছে এই প্ল্যাটফর্ম। বর্তমানে এতে ৫০জন ভলান্টিয়ার কাজ করছেন, যারা ২৪ ঘণ্টা গ্রুপে নজর রাখেন এবং অন্যদের মানসিক সহায়তা প্রদান করে থাকেন। এছাড়াও গ্রুপ মডারেটরের দায়িত্বে আছেন ১০ জন ডাক্তার, ৫ জন সাইকোলজিস্ট, ২ জন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং ১ জন থেরাপিস্ট, পাশাপাশি দুইজন ইয়োগা ইনস্ট্রাক্টর।
এ পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার মানুষ সরাসরি অনলাইন কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে প্রিয় ক্যামেলিয়া থেকে সেবা পেয়েছেন, যার মধ্যে সুইসাইডাল কেস ছিলো ২১৬ টি। গ্রুপটির রিভিউ সেকশনে গেলেই সদস্যদের ইতিবাচক ফিডব্যাকের এক ঝলক দেখে আসা যাবে।
গ্রুপটি থেকে যারা সহায়তা পেয়েছেন তাদের অনেকেই ধন্যবাদ পোস্টের মধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। গ্রুপটির একবছর পূর্তি উপলক্ষে এক ভিডিও বার্তায়, এটিএন বাংলার সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার শামিম আরা মুন্নি বলেন, তিনি এই গ্রুপ থেকে কাউন্সেলিং নিয়ে উপকৃত হয়েছেন এবং তিনি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
ক্যামেলিয়া কামাল বলেন, ২০২০ সালে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছিল যা করোনায় মৃত্যুর চেয়েও বেশি। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অবহেলার চোখেই দেখা হয়। সামাজিকভাবে এটিকে ট্যাঁবু হিসেবে রাখা হয়। তাই আমরা এমন একটু প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছি যেখানে মানুষ নির্দ্বিধায় তার মানসিক কষ্ট শেয়ার করতে পারবে এবং জরুরি সহায়তা পাবে।
তিনি বলেন, 'আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা গোপনীয়তা ও সহমর্মিতার সঙ্গে সম্পূর্ণ খোলা মনে মানুষের কষ্টের কথা শোনেন। তাদের কাউন্সেলিং দেন। বিশ্বের ৪২টি দেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা আত্মহত্যা রোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরাও এই কাজটি করছি।'
গ্রুপের সদস্যদের মতে, 'প্রিয় ক্যামেলিয়ার' সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো - এখানে এক সদস্যের করা কোনো পোস্টে অন্য সদস্যদের কেউ কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করতে পারেন না, জাজমেন্টাল হতে পারেন না। এমন কোনো পরিস্থিতি ঘটলে ভলান্টিয়াররা তাৎক্ষণিক-ভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা ক্যামেলিয়া কামাল জানান, 'শুধু মানসিক সহায়তাই নয়, আমরা কাজ করছি একটি নন জাজমেন্টাল সোসাইটি তৈরির উদ্দেশ্যে, যেখানে প্রত্যেকটি মানুষ ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে একে অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহমর্মি হবে।'