তৃতীয় দেশে বসবাসকারী উইঘুর শরণার্থীদের কানাডায় পুনর্বাসনের জন্য জায়গা দিতে চায় কানাডা। পুনর্বাসনের ব্যবস্থাকে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পার্লামেন্টের সদস্যরা। এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ভয়েজ অব আমেরিকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে উইঘুর গণহত্যার স্বীকৃতি পুনর্নিশ্চিত করার জন্য এবং তৃতীয় দেশ থেকে চীনে নির্বাসনের ঝুঁকিতে থাকা উইঘুর শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য বিশেষ অভিবাসন ব্যবস্থার আহ্বান জানাতে রক্ষণশীল এমপি গার্নেট জেনুইসের একটি প্রস্তাবে সংসদ গত মঙ্গলবার ভোট প্রদান করে। হাউস অফ কমন্স কৃতজ্ঞতার সাথে সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে, বলে জানা যায়।
চীন থেকে নির্বাসিত উইঘুরদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার উইঘুর শরণার্থী তুরস্কে বসবাস করছে, এবং চীন থেকে পালিয়ে আসা উইঘুরদের মধ্যে অল্প সংখ্যক মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে রয়েছে। গত বুধবার সংসদে বিতর্কিত, উইঘুর শরণার্থীদের প্রবেশ ত্বরান্বিত করার জন্য অটোয়ার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপকমিটির চেয়ার পারসন সমীর জুবেরি বলেন, কানাডা আগামী ২০২৪ সাল থেকে শুরু করে দুই বছরের মধ্যে ১০,০০০ উইঘুর এবং অন্যান্য তুর্কি সংখ্যালঘুদের নিজের দেশে স্বাগত জানিয়েছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উইঘুরদের প্রতি চীনের আচরণকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় দেশ কানাডা। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দেশ, এটি একই বছরের জানুয়ারিতে চীনে উইঘুরদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে। ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, লিথুয়ানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র এবং আয়ারল্যান্ডের অন্যান্য আইনী সংস্থাগুলিও একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অক্টোবর ২০২০ এ প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক কানাডিয়ান পার্লামেন্টের বৈদেশিক বিষয়ক উপকমিটির একটি প্রতিবেদনে, কানাডাকে উইঘুর এবং তুর্কি জনগণের মৌলিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখার আহ্বান জানানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
জুবেরি বলেন, "এই প্রতিবেদনের একটি সুপারিশ হল কানাডায় অভিবাসন, শরণার্থী এবং নাগরিকত্বের জন্য উইঘুর এবং অন্যান্য তুর্কি সংখ্যালঘুদের কানাডায় প্রবেশের ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করা। এ বিষয়টি 'হাউস অফ কমন্সে পাস হলেই, আমার দ্রুত এ ব্যাপারে কাজ শুরু করব।"
অটোয়া-ভিত্তিক উইঘুর রাইটস অ্যাডভোকেসি প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক মেহমেত তোহতির মতে, তৃতীয় দেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ উইঘুর শরণার্থী চীনে ফেরত যেতে চান না।
"তুরস্কের মতো দেশে পালিয়ে আসা উইঘুরেরা চীনে প্রত্যাবাসন চান না," বলে তোহতি জানান। "তুরস্কে বেশিরভাগ উইঘুর শরণার্থী বাস করে কিন্তু সে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল। ফলে সেখানে বসবাসরত উইঘুর শরণার্থীদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত দেশটির এমন সিদ্ধান্তে মূলত এই বিষয়টি প্রভাব ফেলবে। যেমন তুরস্ক সরকার উইঘুরদের চীনে ফেরত যাওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখাতে পারে।"
অক্সাস সোসাইটি ফর সেন্ট্রাল এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্টের জুন, ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৭ থেকে মার্চ ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ২৮ টি দেশে উইঘুরদের আটক ও নির্বাসনের ১৫৪৬ টি ঘটনা রয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে ৬৪৭টি মামলা রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ৬৬৫ টি মামলা রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উইঘুরদের তাদের স্বাগতিক দেশে আটকেরই ১১৫১ টি মামলা রয়েছে এবং উইঘুরদের নির্বাসন, প্রত্যর্পণ বা চীনে ফিরিয়ে দেওয়ার ৩৯৫ টি মামলা রয়েছে।
ওইসব দেশে মূলত উইঘুরদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। তাদের নিরাপদ আশ্রয় নেই, বলে জুবেরি জানান। কানাডা সরকার অত্যন্ত মানবিক। এ দেশে ইয়াজিদি, সিরিয়ান, আফগান এবং সম্প্রতি ইউক্রেনীয়দেরকেও স্বাগত জানানো হয়েছে। আশা করা যায় উইঘুরদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও কানাডা আবার কোন পদক্ষেপ নিবে।
জুবেরি জানান, গত বুধবার সংসদে তার প্রস্তাবের উপর নানা তর্ক বিতর্ক হয়। ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে এ ব্যাপারে একটি ভোটের ব্যবস্থা করা হবে।
এ প্রস্তাব যদি অনুমোদন করা হয়, তবে প্রস্তাবটি গ্রহণের পর ১২০ দিনের মধ্যে, শরণার্থী পুনর্বাসন পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে।
কানাডার অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র, রেমি লারিভিয়ের বলেন, "কানাডা 'জিনজিয়াংয়ে উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারটি সাম্প্রতিক জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও জানানো হয়।"
তিনি আরো বলেন, "কানাডা সরকার দুর্বল ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের পুনর্বাসন কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘু, যারা চীনে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছে।"
আগস্টে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জিনজিয়াংয়ের মানবাধিকার বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে চীন উইঘুর এবং অন্যান্য প্রধান জাতিগত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে। এ অপরাধের মধ্যে রয়েছে মানুষদেরকে নির্বিচারে আটক রাখা, নির্যাতনের নানা অভিযোগ, জোরপূর্বক বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমের কাজ করানো, নারীদেরকে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, নারী ও শিশুদের উপর যৌন সহিংসতা এবং তাদেরকে আটকে রাখা।
যদিও চীন দাবি করেছে যে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে পরিপূর্ণ।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), অন্যান্য মনোনীত রেফারেল সংস্থা এবং প্রাইভেট স্পন্সরশিপ গ্রুপের রেফারেলের উপর কানাডা নির্ভর করছে যেন যাদের সত্যিই পুনর্বাসন প্রয়োজন সেসব শরণার্থীদের চিহ্নিত করা যায়।
লারিভিয়ে বলেন, "আমাদের প্রথম কাজ হলো উইঘুর শরণার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া। তাই আমরা আমাদের প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনও ধরনের বিশদ বিবরণ এখনই দিতে পারছি না। কারণ এসব নিয়ে আলোচনার ফলে উইঘুর জনগোষ্ঠী বিপদেও পড়তে পারে।"