মিশরের শারম আল শাইখে গত ১৯ নভেম্বর শেষ হয়েছে কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ-২৭)। বিশ্বের ১৯৮টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এই কপ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে যোগ দেন বাংলাদেশি তরুণ সোহানুর রহমান। বরিশালের ২৬ বয়সী এই তরুণ ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস নামে একটি সংগঠনের নির্বাহী সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্বের যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী কী ধরনের সমস্যায় পড়ছে কপ সম্মেলনে সেটাই তুলে ধরেছেন এই তরুণ।
জলবায়ু সম্মেলনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা প্রদানের বিষয়ে একমত হয়েছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। এজন্যই ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিল গঠন নিয়ে আলোচনা হয়। আর এটিই এবারের সম্মেলনে সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করছেন তরুণ সোহানুর রহমান।
সোহানুর রহমান বলেন, ‘এটা আমার দ্বিতীয় কপ সম্মেলনে অংশগ্রহণ। এর আগে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ সম্মেলনে যোগ দিই। ওখানে প্রায় দুই সপ্তাহ ছিলাম এবং বাংলাদেশের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করি। সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্পেইনে ও সেশনে যোগ দিই এবং বাংলাদেশের গল্পগুলো তুলে ধরি।’
আধুনিক বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ। তাই এটা বাঁচা-মরার লড়াই মনে করেন সোহানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে। এটা শুধু বৈশ্বিক ইস্যু নয়, এটা আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই।’
তিনি বলেন, ‘যেভাবে বিজ্ঞান বলছে, আইপিসিসি বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ উপকূলীয় অঞ্চলে আমাদের বাড়ি-ঘর থাকবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের শতকরা ১৭ ভাগ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সুতরাং এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’
কীভাবে এবারে কপ সম্মেলনে বাংলাদেশি তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনে যোগ দিয়ে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে স্কটল্যান্ডের রাস্তায় আন্দোলন করেছি, কথা বলেছি। বাংলাদেশি ছেলের এমন কাণ্ড বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনায় আসে। তাই বাংলাদেশ সরকার এবারের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমাকে ব্যাজ দেয়।’
বাংলাদেশি তরুণ সোহানুর রহমান বলেন, ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ)-এ কিছু অবজারভার থাকে। বিভিন্ন এনজিও, ইয়ুথ ও মিডিয়া অবজারভার হিসেবে কাজ করে।
গত ত্রিশ বছরে বাংলাদেশ এই প্রথম অফিসিয়াল ডেলিগেট হিসাবে অংশ নিয়েছে। সোহানুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে ছিলাম অবজারভার। এবার আমাকে যে ব্যাজ দেওয়া হয়, সেটা নিয়ে সম্মেলনের যেকোনো জায়গায় প্রবেশ করতে পেরেছি। অর্থাৎ যেকোনো নেগোসিয়েশন রুমে প্রবেশ করার সুযোগ ছিল। আর এই কারণেই আমাদের দাবি ও সমস্যাগুলো নেগোনিয়েশন টেবিলে পৌঁছে যায়।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এই বিপর্যয়ে সরাসরি ভুক্তভোগী ইমরান হোসেন। তার গল্প একটু ভিন্ন ধরনের। বর্তমানে এই তরুণ ইয়ুথ ফেলো হিসেবে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-এ কাজ করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ-২৭)-এ তুলে ধরেন তিনি।
ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমি যখন ছোট, তখন অনেক ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। আম্ফান ও বুলবুল দেখেছি। গ্রাম থাকতাম, বুঝতাম না যে আসলে মানবসৃষ্ট কারণেই এমন দুর্যোগ বাড়ছে। তখন আমাদের এলাকায় এটা কুসংস্কার হিসেবে সবাই জানত। বলা হতো পাপের কারণে দুর্যোগ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে আমি একদম গ্রাম পর্যায়ে ছিলাম। আমার বাবা অন্যের জমিতে কাজ করতেন। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ে আমার বাবাকে হারাই। পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। সবকিছু হারিয়ে আমরা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে চলে আসি। এরপর আমার মা আমাদের সংসারের হাল ধরেন। অর্থাৎ, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমরা অনেক কিছুই হারাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের জীবনমান পরিবর্তন হচ্ছে। এরজন্য আমাদের দেশ দায়ী নয়। উন্নত দেশগুলো কারণে গরীব দেশগুলো ভুক্তভোগী হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কীভাবে দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, সেটা স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে আলোচনা করা শুরু করি।’
একজন ভুক্তভোগী হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সমস্যাগুলি কপ সম্মেলনে তুলে ধরেন ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, ‘কপ সম্মেলনে জি-৭৭ এ আমার যাওয়ার সুযোগ হয়। ওখানে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্যায় পড়ি সেটা শেয়ার করি। তারপর আমাদের সমস্যাগুলো সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।’