বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

কষ্টই তাদের আজন্ম নিয়তি

প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেভাবে টিকে আছে সুন্দরবন-সংলগ্ন মানুষ

আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৪:০২

কথায় আছে, ‘সুন্দরবনের জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ’। সে সঙ্গে নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘ঝড়-জলোচ্ছ্বাস’। বাঘ, কুমির আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রাম করে কোনো রকম টিকে আছে সুন্দরবন-সংলগ্ন গ্রামগুলোর হতদরিদ্র মানুষ। পরিবারের সবাই মিলে কঠোর সংগ্রাম করেও তাদের তিন বেলা ভাত জোটে না।

জেলা শহর খুলনা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে কয়রা উপজেলা সদর। এখান থেকে আরো প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাঠকাটা গ্রাম। এখান থেকে সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ইট বিছানো ভাঙাচোরা অপ্রশস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে আরো চার কিলোমিটার গেলে বীণাপানি, গাববুনিয়া, শেখবাড়ি, হরিহরপুর শেষে পড়বে গাতিরঘেরি গ্রাম। ওপারে সুন্দরবন, এপারে লোকালয়, মধ্যখান দিয়ে বয়ে গেছে কম প্রশস্তের ছোট্ট নদী শাকবাড়িয়া। বীণাপানি, কাঠকাটা, গাববুনিয়া, হরিহরপুর, গাতিরঘেরি গ্রাম ঘুরে জানা গেল, সুন্দরবন লাগোয়া এই গ্রামগুলোর মানুষের অজানা এক জীবন সংগ্রামের কথা। দুর্গম এই জনপদের এক একজন মানুষের জীবনের চিত্র যেন এক একটি সিনেমার গল্প।

ঔপন্যাসিক জরাসন্ধ তার লৌহকপাট উপন্যাসে সুন্দরবন-সংলগ্ন মানুষের জীবন সম্পর্কে বলেছেন, ‘এরা সুন্দরবনের লোক। বাঘ, সাপ, কুমির আর বুনো শুয়োর এদের নিত্যসঙ্গী। তার ওপর মাঝেমধ্যে আসে বন্যা, মহামারি। উঠতে বসতে মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাতিরঘেরি গ্রামে ৮৪টি পরিবারের বসবাস। এদের অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র শ্রেণির। অভাবের কারণে ছেলে-মেয়েদের বেশির ভাগই স্কুলে যায় না। যে সময় স্কুলে লেখাপড়া করার কথা, সে সময় তারা শাকবাড়িয়া নদীতে জাল পেতে মাছ ধরে সংসারে কিছু সাহায্য করতে। তাছাড়া গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্বও দেড়-দুই কিলোমিটার। গ্রামের চলাচলের একমাত্র সরু রাস্তাটির (বেড়িবাঁধ) অবস্থাও শোচনীয়। রাস্তার বহু স্থানের ইট উঠে গেছে। গাড়ি চালানো তো দূরের কথা, হেঁটে চলাই দায়। গ্রামের কেউ অসুস্থ হলেও নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে কয়রা উপজেলা সদরেও নেই সরকারি বড় কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি উপজেলা সদর থেকে আরো ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে আমাদি ইউনিয়নের জায়গীরমহল গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার পথে পথিমধ্যেই মৃত্যু ঘটে অনেকের।

গাতিরঘেরি গ্রামের কাজল সরকার বলেন, ‘এ গ্রামে কোনো কাজ নেই। লবণাক্ততার কারণে গত তিন বছর ধরে জমিতে ফসল ফলে না। সবজিও হয় না। মাটি কাটার কাজ করি। নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরি। মৌসুম হলে বন বিভাগের পাশ নিয়ে মালে যাই (সুন্দরবন) মাছ ধরতি। এই দিয়েই কোনো রকম চলে আমাগের সংসার। তিনি বলেন, এখন কাজ নেই। বেকার। খুব কষ্টে কাটছে জীবন।’

তপন মণ্ডল বলেন, ‘বিপদাপদ আমাগের সব সময় লাগেই থায়ে। সুন্দরবন মাছ ধরতি গেলি অনেক সময় বাঘে ধরে নিয়ে যায়, আবার বিষাক্ত সাপেও কামড়ায়। বাঘের হাত থেকে অনেকরেই বাঁচায়ে নিয়ে আইছি। আমরা বাঘের ভয় আর পাইনে। ঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রেও (সাইক্লোন শেল্টার) যাইনে। আমরা বাঁধের সঙ্গে নৌকা বাইন্ধে থাহি। ভাগ্যের ওপর ভরসা করেই বেচে আছি।’ তার স্ত্রী রেণুকা বলেন, আইলা গেছে, সিডর গেছে, আরো কত ঝড় গেল—কোনো দিন আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাইনি।

৬৫ বছরের বৃদ্ধা দেবলা দাস বলেন, আমাগের কোনো কাজ নেই। শাকবাড়িয়া নদীতে জাল বেয়ে মাছ ধরি। এ দিয়ে কোনো দিন পাই ১০০ টাকা, কোনো দিন ৮০ টাকা। আবার কোনো দিন ৭০ টাকা আয় হয়। এই টাকার ওপরই ভরসা তিন জনের সংসারের। খাবার পানির খুবই সংকট। চেয়ারম্যান মেম্বারদের কেউই আমাগের খোঁজখবর নেয় না।’ গ্রামবাসীরা বলেন, সিডর, আইলা, আম্ফান, মহাসেন কত নামের ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আসে, আমাদের বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কত মানুষ মারা যায়। তার পরও যারা বেঁচে থাকে তারা ভালো কিছুর আশায় আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, আমি সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ এলাকার উন্নয়নে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জাইকা ও বিশ্ব ব্যাংকের আরো অনেক প্রজেক্ট রয়েছে।

 

ইত্তেফাক/ইআ