জয়দীপ দে লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। তার ইতিহাস আশ্রয়ী লেখা বেশি জনপ্রিয় হলেও তিনি বিজ্ঞান নিয়ে কাজও করেছেন। তার যেকোনো লেখায় তিনি স্বপ্নের কথা বলেন বেশি।
তার মতে, ‘দেখেন হতাশা ছড়ানোর মানুষের অভাব নেই। হতাশার উপাদান চারদিকে। কিন্তু এটাও ঠিক যে অন্ধকারের মধ্যেও যদি একটি দেয়াশলাই এর আগুন জ্বলে সেটি অনেকদূর থেকে দেখা যায়। এই আলোর দেখা দেওয়াটা, মানুষকে সঞ্জীবীত করা এটা খুব দরকার সমাজে। না হলে এই সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। হতাশা থাকবে। এর মধ্যে স্বপ্নের কথা বলতে হবে। মানুষকে জাগাতে হবে। বাংলাদেশে যে ব্যাংক লুট থেকে এখন যে ঘটনাগুলো সেগুলো কিন্তু ইংল্যান্ডেও হয়েছে, জার্মানিতে হয়েছে। আমাদের জাতির বয়স মাত্র পঞ্চাশ বছর। ওইসব জাতি শত শত বছর পেরিয়ে এখন আলোর কথা বলছে। তারপরও যেসব দেশে যে হতাশা নেই তা নয়। আমি যেহেতু শিক্ষকতা করি তাই শিক্ষার্থীদের মনে আলোর দ্বীপশিখা জ্বালিয়ে যাই।’
এবারের বইয়ের বিষয়বস্তুওতো ইতিহাস নিয়ে?
‘এই বইটা আসলে বিষয়হীন বই। কিন্তু আমার যেটা হয়। আমি তো ইতিহাস নিয়ে কাজ করি। ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিচরণ করি তখন খুব ছোট ছোট মজার ঘটনাগুলো পাই। এগুলো হয় তো আমার কোনো উপন্যাস, গল্প বা প্রবন্ধে জায়গা পায় না। সেই ছোট ছোট গল্পগুলো এই বইতে কুড়িয়ে এনেছি। আমি বইটির নাম দিয়েছি ইতিহাসের খোলামকুচি। রাস্তায় যেমন খোলামকুচি পড়ে থাকে আমরা কুড়িয়ে নেই। তেমনি সরস ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে এক করেছি। হয়তোবা কেউ প্রথমে পড়লে মনে করবে বিক্ষিপ্ত একটা বই, সঙ্গতিহীন। কিন্তু প্রতিটি গল্পের পেছনে ইতিহাসের একটা মোড়, বড় কোনো ঘটনা বা একটা জাতি গোষ্ঠীর জেগে ওঠা বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কাহিনি রয়েছে।’
যেমন?
‘প্রথম গল্পটা হচ্ছে, গঙ্গা নামে বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে। পাকিস্তানে কিন্তু তাদের বিরোচিত সংবর্ধনা দিয়েছিল। এই সংবর্ধনা দেওয়ার কারণ হচ্ছে তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য বিমানটা ছিনতাই করেছিল। পরে কিন্তু দেখা যাচ্ছে এটা ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর একটা ফাঁদ ছিল। ভারতীয়রা জানতো যে যুদ্ধ আসন্ন। তাই বিমান আসা যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য একটা নাটক সাজিয়েছিল। এ রকম ইতিহাসে যে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে তেমন সারা পৃথিবীর ছোট ছোট গল্প আছে এই বইয়ে।’
আর কোনো মজার ঘটনা?
‘যেমন এই যে আফগানিস্তান। আজকে যে এই অবস্থানে আসছে। এটা কিন্তু সত্তরের দশকে বেশ সমৃদ্ধ একটা জনপদ ছিল। আজকে যে আমরা আমেরিকা বা মুজাহিদীনকে দায়ী করি। আফগানিস্তানের পতনের শুরুটা কিন্তু কমিউনিস্টদের হাতে। কমিউনিস্টরা কিন্তু যখন যেটা করা দরকার সেটা করেনি। এদের বিরুদ্ধেই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য পাঠায়। একই ঘটনা ঘটে কিন্তু ইরানে। সেখানেও কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি এক সময় মোল্লাতন্ত্রকে সাপোর্ট দিয়েছিল। আজকে সেই কমিউনিস্ট পার্টি বিলুপ্ত। সঠিক সিদ্ধান্তহীনতা এবং প্রগতিশীল শক্তিগুলোর যখন যে ভূমিকা রাখা দরকার সেটা রাখতে পারেনি বলেই কিন্তু অনেকগুলো দেশের বিপর্যয় দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে বলি, আফগানিস্তানে এক রানি ছিলেন। উনি কিন্তু আফগানিস্তানে অনেক সংস্কার করেছিলেন বিশেষ করে নারী শিক্ষার বিষয়ে। তার কথা সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বইয়েও রয়েছে। একটা জাতি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যে কীভাবে উলট-পালট হয়ে যায় তেমন অনেক বিষয় ধরা পড়েছে এখানে।’
ইতিহাসের বই নিয়ে লেখার প্রেরণাটা ঠিক কোথায় থেকে পেলেন?
‘আমি এখানে একটু পেশাগত পরিচয় দেই। সিভিল সার্ভিসে চাকরি করি। তো বিসিএস পরীক্ষা দিতে দিয়ে বিভিন্ন ইতিহাস, সাল-তারিখ এসব মুখস্ত করতে হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু নেই। আত্মপ্রবঞ্চনা। কতোগুলো সংখ্যা মুখস্ত করা আর ওগরে দেওয়া আর কি! তখন আমার মনে হলো যদি সুযোগ পাই অন্তত একটু একটু করে সারা পৃথিবীর ইতিহাস আমি পড়া শুরু করবো। এরপর আমি শখ করে আফ্রিকার ইতিহাস পড়া শুরু করি। তারপর লাতিন আমেরিকার। ইতিহাস পাঠের সময় মনে হলো এটা কতো প্রাণময়। আমরা কিন্তু সেটা ওভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারি না। গল্পের আঙ্গিকে যদি তুলে ধরতে পারি তাহলে তথ্য বোঝা বহন করা লাগবে না। সংখ্যার বোঝা বহন করা লাগবে না। ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের এ ধরনের নৈকট্যও আসবে। সেই থেকে আসলে এই বইটি লেখা।’
‘এখানে একা কথা বলি, ইতিহাস আশ্রয়ী লেখাগুলো হয়তো আমার পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কিন্তু এর বাইরেও আমি কাজ করি। যেমন বিজ্ঞানের ওপরও আমার বড় কাচ আছে। দশ খণ্ডের কাজ। আজ থেকে পঞ্চাশ/ষাট বছর আগে যে প্রবন্ধগুলো বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য লেখা হয়েছিল সেগুলো ধারণ করার চেষ্টা করেছি। আমি রেলের ইতিহাস নিয়েও লিখেছি। বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছি। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে এই অঞ্চলে অনেক কাজ করার জায়গা থাকলেও সেভাবে কাজ করা হয়নি।’
এর আগের বইগুলোর নিয়ে একটু জানতে চাই?
‘আমার বই বের করার ইতিহাস আসলে ২০১৩ সাল থেকে। সেই সময় শুদ্ধস্বর থেকে একটা গল্পের বই আসে ‘হারকিউলিসের পাখা’। এরপর দীর্ঘদিন বই বের হয়নি। আমাদের দেশে আসলে প্রকাশনা শিল্পটা বেশ জটিল। পাঠক কম আবার প্রকাশকরা আগ্রহবোধ করেন না। ২০১৮ সালে শব্দঘর থেকে একটা প্রতিযোগিতায় একটা উপন্যাস ছাপা হয়। সেটি পরে বই আকারে বের হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আপনি ও আমরা একই সময়ে যাপন করেছি। সেই সময় যে একটা টার্নিং সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি সেটাই আছে এই উপন্যাসে। এর পরের বছর একটা উপন্যাস লিখি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ‘গহন পথে’। আরেকটা ভ্রমণ কাহিনী ‘মাদ্রাজের চিঠি’, তারপরের বছর আসে ‘বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জয়’, ‘কাসিদ’ নামে একটা বই আসে পলাশীর যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে অনেক কার্টুন কলকাতার পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেগুলো ভারতের আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করে ‘একাত্তরের কার্টুন’ নামে প্রকাশ করি। ‘উদয়ের পথে’ উপন্যাসটি ৪৬ থেকে ৫২ সময়কাল। ভারত ভাগ ও আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ নিয়ে।’
জয়দীপ দে’র এবারের বই ‘ইতিহাসের খোলামকুচি’ প্রকাশ করেছে কবি প্রকাশনী। জয়দীপ বলেন, তিনি চেয়েছেন বইটির দাম কম রাখতে সে কারণে প্রকাশককে চাপ দিয়েছেন। কাজেই বইটি পেপারব্যাক করেছে। এতে দাম অনেক কমে গেছে। মুদ্রিত দাম রাখা হয়েছে ৫৩৫ টাকা। বইমেলায় বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়।