শনিবার, ১০ জুন ২০২৩, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

তারুণ্যের চোখে ভালোবাসা দিবস

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:০১

ভালোবাসা একটি সুন্দর শব্দ। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে তা টিকে আছে ভালোবাসায়। এ ভালোবাসার শক্তিতে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে, আবার এই ভালোবাসার অভাবেই বরণ করে মৃত্যুকে। তাইতো মানব জীবনে ভালবাসার গুরুত্ব মেলাভার। এ গুরুত্বকে পরিস্ফুটন করতেই সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে যুগ যুগ ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে ভালোবাসা দিবস। ঠিক কবে কখন কোথা থেকে এ ভালোবাসা দিবস উদযাপনের সূচনা তা নিয়ে মতবাদের অন্তঃ নেই। কেউ কেউ মনে করেন ভালোবাসা দিবস পালিত হয় প্রাচীন রোমের প্রেমের দেবী জুনোকে স্মরণ করে। আবার কারো কারো মতে ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হয় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর করুণ হৃদয় বিদারক প্রেমের কাহিনীকে স্মরণীয় করে রাখতে। ভ্যালেন্টাইন ছিলেন রোমের এক সাহসী ও হৃদয়বান বীর। তবে তার জীবদ্দশায় রোমের রাজা ক্লোডিয়াস ছিলেন এক নিষ্ঠুর শাসক। হঠাৎ তার ভ্রম হয়েছিল যে, বিবাহিত সৈন্যদের চেয়ে অবিবাহিত সৈন্যরা বেশি কর্মঠ। এমন মনোভাব থেকে তিনি তরুণ বীরদের বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেন। তাঁর এই নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে ভ্যালেনন্টাইন তরুণদের গোপনে বিয়ে দেয়া শুরু করলে রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ভ্যালেন্টাইনের এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে। ঘটনা প্রসঙ্গে লোকশ্রুতিতে আর জানা যায়, কারাগারে থাকা অবস্মৃতায় এক কারারক্ষী নারীর প্রেমে পরে ভ্যালেন্টাইন। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে সে তাঁর প্রেমিকাকে লিখেছিলেন এক মিষ্টি চিঠি- 'ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন'।

ভালবাসা দিবস যে কারণেই উদযাপিত হোক না কেন এ যে কেবল দুটি নিষ্পাপ তরুণ মনের শুভ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাইতো প্রতিবছরই ভালোবাসা দিবসে তরুণদের মাঝে অনাবিল উচ্ছ্বাস বয়ে যায়। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভালোবাসা দিবসকে কিভাবে উদযাপন করছে তরুণরা?-এমন মনোভাব জানতে চাওয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাফা আক্তার নোলক বলেন, 'সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা দিবস আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলোর প্রতি অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিন। হতে পারে সেটি আমাদের পরিবারের প্রিয় মানুষ, হতে পারে আমাদের বন্ধু-বান্ধব কিংবা জীবনসঙ্গী -এদের সবাইকে নিয়ে একসাথে উল্লাস করার দিন এটি। এবং সেই মানুষগুলো যারা আমাদের জীবনে ভালোবাসা ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে তাদের ঘটা করে ভালোবাসি জানিয়ে দেওয়ার দিন এই ভালোবাসা দিবস।' 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ। একটা সময়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুণতে হতো। অথচ এখন ফেসবুক-মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা টুইটারে ঢুঁ মারলেই তাকে দেখা যায় প্রিয়জনকে। সেই পুরনো দিনে চিঠিতে খুব যত্নে সাজানো শব্দে ঘটতো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। অথচ এই আধুনিক যুগে ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশ করছি আমরা মনোভাব, চলছে বিরামহীন কথা। ভালোবাসা প্রকাশের এমন রং বদলকে কিভাবে দেখছে তরুণ প্রজন্ম? এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর রহমান বলেন, 'চিঠির যুগটায় যখন প্রেমিক-প্রেমিকারা চিঠি লিখতো, তারা এমনভাবে লিখতো যেন ছোট্ট একটা কাগজে সকল মায়া, মমতা, রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পেয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান যুগে বার্তা আদান-প্রদানকালে আমরা আসলে পার্থক্য করতে পারি না যে ছোট্ট একটা টেক্সটে ওই পাশের মানুষটা আসলে কী বুঝাতে চেয়েছে। মাঝেমধ্যে তো ভাবিও না এই ব্যাপারে যে টেক্সটটা গুরুত্বপূর্ণ কিনা! আর যেহেতু এখন পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ, মেলামেশা খুবই সহজ, সেইজন্য আমার আমরা ভুলে যাই যে প্রেমিক/প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হওয়াটা একটা স্পেশাল ফিলিংস/ইভেন্ট। বর্তমানে আমরা খুব সহজেই অভ্যস্ত হয়ে যাই, যার ফলে সেই স্পেশাল টাচটা হারিয়ে যায়।' 

একটা সময় প্রেম ছিল কেবল একটা মানুষকে কেন্দ্র করে। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রাশ, ফ্যান, জাস্ট ফ্রেন্ড এর মত শব্দগুলো। এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে এ প্রজন্ম? জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা মাহমুদ মিষ্টি বলেন, 'সত্যিকারের ভালোবাসা আসলে এককেন্দ্রিকই হয় হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ভালোবাসার কোন রিপ্লেসমেন্ট হয় না। অথচ এখন ভালোবাসায় যে প্রকারভেদগুলো দেখা যায় তা ভালোবাসা শব্দটির মহিমাকেই কলুষিত করে।' 

গবেষণা বলে প্রেমে পড়লে আত্মঃবিশ্বাস বাড়ে বহুগুণ। এর জন্য হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াও সচল হয়, আসে জীবনে সফলতার ছোঁয়া। তাই জীবনের সাফল্যের জন্য কি ভালোবাসার জরুরী? এমনটা জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য রাউত প্রতীক বলেন, 'নিশ্চয়ই! প্রেমে পড়লে বা প্রেম সফল হলে মানুষ জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তিটাই অর্জন করে ফেলে। প্রতিটি সফল মানুষের পিছনে অনুপ্রেরণাদাতা হিসেবে দেখা আরেকজন মানুষ মিশে আছে৷ যিনি পরম মমতায় আগলে রাখেন প্রিয়জনকে। সকল ক্লান্তি দূরীকরণের মেডিসিন হিসেবে সে অসাধারণ। যার অতুলনীয় সৌন্দর্যে দিনশেষে মুগ্ধ হয় প্রিয়জন। তাছাড়া একজন মানুষ প্রেমিক হলে অনায়েশেই নিয়মানুবর্তিতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে, জীবনে সফলতা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, প্রেমিক/প্রেমিকার  মুখে হাসি ফুঁটাতে সফলতার প্রচেষ্টা করা এক প্রকার প্রেষণা হিসেবে কাজ করে।' 

আজকাল ভালোবাসা কি ট্রেন্ড ফলো করছে নাকি ট্রেন্ড ভালোবাসা ফলো করছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর রহমান বলেন, 'ট্রেন্ড ভালোবাসা ফলো করে কিনা জানি না; কিন্তু ভালোবাসা ট্রেন্ড ফলো করে। অন্ততপক্ষে এমন একটা মোহ তৈরি করে যে বিশেষ দিনগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে কোনো একটা মুহূর্তের পোস্ট করাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ভালোবাসা তো এমন হওয়া উচিত না, তাই না?' 

প্রিয়জনের সাথে অবিরত যোগাযোগে মাতৃভাষা প্রয়োগের জুড়ি নেই। তবে এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলিশ, কথার পরিবর্তে এসেছে ইমোজি। এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে বলা হলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহিদা আরবী জানান, 'আমাদের বাংলা ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে আজকাল ভাষা ব্যবহারে যথেষ্ট অসেচতনতা দেখা যায়। 'ভালোবাসি' শব্দটিতে যে পরিমাণ আকুলতা সৃষ্টি হয় ফেসবুকের 'লাভ ইমোজি' হয়তো তার ১ শতাংশ এতে দিতে পারেনা। বানানের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা, বাংলিশের ব্যবহার আর সংক্ষিপ্তরূপের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা প্রকাশের সেই চিরায়ত আবেদন।  ভালোবাসা নির্মল। তাই প্রকাশের মাধ্যমটাও থাকুক সঠিক, শুদ্ধতায় ভরা।' 

আজকাল প্রেম করে বিয়ে করার সংখ্যাও বেশি আবার ডিভোর্সের সংখ্যাও বেশি। অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। এই বিচ্ছেদের কারণ কি জানতে চাইলে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাকিরুল আলম শাকিল বলেন, 'ইদানীং সম্পর্ক কিংবা ভালোবাসায় যে বিচ্ছেদের পরিমাণ বাড়ছে তার একটি বড় কারণ হচ্ছে ‘সঙ্গী নির্বাচনে ব্যর্থতা’। সাধারণত বিচ্ছেদ হয় তখনই যখন দুজনের মতের ভিন্নতা তৈরি হতে থাকে। সঙ্গী বা বন্ধু নির্বাচনের সময়ে আমাদের সবসময় নিজের মতাদর্শের সাথে যায় বা খাপ খাই—এই দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ। বিপরীতজনকে বোঝার জন্য একটু সময় নেওয়া প্রয়োজন। আবেগের বশবর্তী হয়ে বাছ-বিচার না করেই হুট করে গড়ে তোলা কোন সম্পর্কই খুব বেশিদিন টিকে নাহ।' 

রূপ যৌন কিছুই চিরস্থায়ী নয় তবে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের বন্ধন। মোহ কেটে গেলও একটা সময় বন্ধুত্বই টিকিয়ে রাখে ভালোবাসাকে। তাই ভালোবাসার সম্পর্কটিতে বন্ধুত্ব কতটা জরুরি জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. মিজান রহমান বলেন, 'একটি সুন্দর-গোছানো সম্পর্কের মধুরতা বজায় রাখতে বন্ধুত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা, বন্ধুত্ব না থাকলে একজন আরেকজনকে বুঝে উঠতে পারব না। মতামত-পরামর্শে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারব না। প্রাধান্য দিতে পারব না। আর এখানেই বাধবে বিপত্তি। তৈরি হবে বিশৃঙ্খলা; গড়াবে ডিভোর্সের দিকে। তাই সম্পর্কের সুমিষ্টতা বজায় রাখতে বন্ধুত্বটা থাকা চাই৷" মিজানের কাছে আরও জানতে চাওয়া হয়েছিল: প্রকৃতিতে বসন্ত এলে যেমন ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বৃক্ষরাজি। প্রাণ ফিরে পায় সজীবতা। তেমনি ভালোবাসা কি জীবনের বসন্তকে ফিরিয়ে আনে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'নিশ্চয়ই! প্রেম আমাদের প্রফুল্ল ও কর্মচঞ্চল করে তোলে। প্রিয়জনের সাথে এক মুহূর্তের কথাতে সারাদিনের সকল ক্লান্তি ভুলে যাই আমরা। এই প্রিয়জন হতে পারে বাবা-মা, ভাই-বোন বা প্রিয়তম। তাই নিঃসন্দেহেই বলা যায় ভালোবাসা জীবনের বসন্ত।' 

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন