শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘রাষ্ট্র একটি জীবন্ত শরীর, নারী ও পুরুষ দুটি বাহু’

আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৩, ২২:২০

মাকসুদা বেগম। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন চলতি বছর। দেশ-বিদেশে আর্থিক খাতের নানা সভায় তিনি নিয়মিত অংশ নেন। নারীর সক্ষমতা ও স্বাধীনতা নিয়ে তারও কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। ২০২৩ সালে নারী দিবসের প্রধান প্রতিপাদ্য  ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, লিঙ্গ বৈষম্য করবে দূরীকরণ নিয়ে দিয়েছেন মূল্যবান মন্তব্য। তার বিশ্বাস ডিজিটাল বাংলাদেশ যে পরিকল্পনায় এগিয়ে চলেছে সে বিবেচনায় অবশ্যই তা সম্ভব। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি দেখলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল তাতে সন্দেহ নেই তার। ভবিষ্যতেও বৈষম্য থাকবে না এমন এক স্বপ্ন নিয়েই দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে চলেছেন। কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় স্বচক্ষে সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেখেছেন। একটা রাষ্ট্র তার কাছে একটি জীবন্ত শরীর। সেখানে নারী ও পুরুষ দুটি বাহু। এই শরীরের ব্যবহারে সুষ্ঠ ফলাফল পাওয়ার জন্য এই দুটি বাহুকে শক্তিশালী করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। দেশের জনসংখ্যার বিচারে নারী পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই যদি নারী হয়ে থাকে এবং এই তাদের জনসম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারলে ওই রাষ্ট্রের উন্নতি হবে না। 

তিনি মনে করেন, নারীকে জনসম্পদ হিসেবে দেখা উচিত। তাহলেই দেশ আরও উন্নত হবে। তিনি দেখেছেন একসময় গ্রামীণ অঞ্চলের নারীদের কাজ-গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল। গৃহস্থালি কর্মকাণ্ড যে কম শ্রমসাধ্য তা কিন্তু নয়। বরং কঠিন একটি কাজ। সম্প্রতি আধুনিক বিশ্বে গৃহকর্মকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও জাতীয় আয়ে এগুলো এখনও অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। সে হিসেবে নারীর গৃহকর্ম এখনও অবমূল্যায়িত। অফিসে কাজ করা আরও সহজ তুলনামূলক হিসেবে। কিন্তু সন্তান প্রতিপালন করার কাজটি সহজ নয়। এখন বাবারও দায়িত্ব নেন তবে মায়ের ভূমিকা নেওয়া সহজ নয়। নারীকে অনেকগুলো ভূমিকা পালন করতে হয়। 

স্বাধীনতার মাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদানের কথা স্মরণ করেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতাও রয়েছে মাকসুদা বেগমের। স্বাধীনতার সময় তিনি অনেক ছোট থাকলেও মা-দাদিদের দেখেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করতে। এটিও এক উপায়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ তা বুঝতে পেরেছেন। তার মা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং নানাভাবে আত্মগোপনে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশ বাড়ায় যুদ্ধের পথ সহজ হয়েছে বলে মনে করেন। তারই স্বীকৃতি তারামন বিবি এবং বীরাঙ্গনারা। যুদ্ধে তারা সম্ভ্রম ও প্রাণ হারিয়েছেন।  

স্বাধীনতা মানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। নারীকে সব অধিকার ও তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি। নারীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী এখনো সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। চাকরিক্ষেত্রে নিয়োগে বৈষম্য রয়েছে। অনেক পেশায় নারীকে সুযোগ দেওয়া হয় না। সামাজিক ভাবনা নারীকে বেঁধে রেখেছে। অনেক নারী যোগ্যতা থাকার পরও পারিবারিক গণ্ডিতে আবদ্ধ। ধর্মীয় বাঁধাও একটি বড় সমস্যা। এমনকি নারী যখন উদ্যোক্তা তখন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও তার নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। ব্যাংকগুলো এত সহজে তাকে ঋণ দেয় না। আবার নারী নিজ নামে ঋণ নিলেও তার স্বামী তা কেড়ে নেয়। নারী প্রতিবাদ করার সুযোগই পায় না। এভাবে তার অর্থনৈতিক বাঁধা রয়েছে। যারা বাঁধা ডিঙাতে পেরেছেন তারাই ভালো কিছু করেছেন। যারা পারেননি তারা কিন্তু সমস্যাক্রান্ত। সম্প্রতি ডিসি, এডিসি, ইউএনও, সচিব এসব ক্ষেত্রে নারী আছেন। কিন্তু সংখ্যাটা বেশি নয়। এখনো বড় একটি অংশ স্বাধীনতা পায়নি।

যদি সব প্রতিবন্ধকতা এড়ানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে বলেন তিনি। নিজের অধিকার অন্যদের বোঝাতে হবে। মাকসুদা বেগম মনে করেন, বিশেষত ফতোয়াবাজ বা ধর্মীয় গোঁড়ামির জায়গায় আঘাত করতে হবে। কারণ বিবি খাদিজার যুগেও তো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল নারীর। এখন তবে থাকবে না কেন। কোনো ধর্মই তো নারীকে আটকে রাখেনি। তাকে ব্যবসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অবশ্যই পারিবারিক সহযোগিতা জরুরি। পারিবারিকভাবে মাকসুদা বেগম নিজে সাহায্য সহযোগীতা পেয়েছেন। তার স্বামীও তাকে এ ব্যাপারে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতার বিষয়ে ইতিবাচক ভাবনা গড়ে তোলার জন্যে সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি দেখতে পান দেশের গ্রামীণ অঞ্চলের সিংহভাগ কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। তারা বৈষম্যের শিকার হয় বেশি এবং কর্মক্ষেত্রেও টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু এখানে করণীয় হলো নারীকে কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া। নারীকে কর্মমুখী শিক্ষা দিতে পারলে সে নিজের কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিতে পারবে। আবার শুধু কর্মক্ষেত্র তৈরি করাই পর্যাপ্ত নয়। তাদের সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে এটুকু তো সহজেই বোঝা যায়। সরকার ইতিমধ্যে নানা প্রক্রিয়ায় তা করা শুরু করেছে। দেশে কর্মজীবী নারী হোস্টেল আছে কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। গ্রামীণ অঞ্চল থেকে এসে আবাসনের নিরাপত্তা না পেলে তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। আবার নারীকে তো সন্তানের দায়িত্বও নিতে হয়। এখন ব্যাংকগুলোতে ডে কেয়ার সেন্টারের নির্দেশনা আছে। এভাবে নারী কর্মস্থলে মনোনিবেশ করতে পারে খুব সহজে। এভাবে নারীর জন্য কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। নারীর সুবিধা আস্তে আস্তে নিশ্চিত হচ্ছে। এক সময় কোটার মাধ্যমে কর্মস্থলে পৌঁছালেও এখন কোটার বাইরেও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মেধা ও প্রতিভার ব্যবহারে এগিয়ে চলেছে। নিয়োগে নারীর সংখ্যা বাড়লেও অংশগ্রহণ অতো বেশি না সবখাতে। যদি তা বাড়াতেই হয় তাহলে নিরাপদ পরিবেশ ও কর্মস্থল গড়ে তুলতে হবে। কাজ করার সময় যেন কোনো বিঘ্ন তৈরি না হয়। সরকার এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিলে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। রাষ্ট্রের শরীরের একটি অংশ অদক্ষ থাকলে রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হতে পারে না।

সম্প্রতি এক অর্থনৈতিক সংকটকাল পার করতে হয়েছে। তিনি তার সংশ্লিষ্ট খাতের উদাহরণ টেনেই বলেন, করোনার সময় অনেক পুরুষই চাকরি হারিয়েছে। বিভিন্ন খাত থেকেই নানা কারণ দেখিয়ে তাদের কর্মচ্যূত করা হয়েছে। অনেক মিল-কারখানা বন্ধ থাকায় বেতন দিতে পারেনি। ওই সময় পরিবারগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে কিন্তু নারীরা। ঘরে নানা কাজকর্ম করে তারা অর্থের জোগান ধরে রেখেছে। পুরুষরাই যে সবসময় নারীদের অবলম্বন তা নয়। করোনাকালে আমরা এর উল্টোচিত্রই দেখেছি। এখন যিনি নারী উদ্যোক্তা তিনি শুধু সংসার সামলাচ্ছেন তা না। তিনি আরও কর্মসংস্থান গড়ে তুলছেন। অন্য নারীদের প্রশিক্ষিত করে তুলছেন। কুটিরশিল্পে নারীর অগ্রাধিকার বেশি। একজন নারী উদ্যোক্তা আরও নারীদের সাহস জুগোচ্ছে। আমি মনে করি, নারীকে ব্যাংক থেকে শুরু করে অন্য সুবিধা দিলে তারা আরও ভালো করবে।

মাকসুদা বেগমের বিশ্বাস এ বছরের প্রতিপাদ্য যদি সত্যিই সফল করতে হয় তাহলে নারীর সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতেই হবে। নারীর সার্বিক উন্নয়নে সবার প্রথমে শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। নারী শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে এখনও প্রান্তিক অঞ্চলে ভুল ধারণা আছে। নারী সংস্থাগুলোকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা নারী, আমরাও পারি এই মূলমন্ত্রটি সবখানেই পৌঁছে দিতে হবে এই তার মত। সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়াতে শিক্ষাবৃত্তি ও বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নারী তার সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কি-না সেজন্য নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাও তার ভাবনায় রয়েছে। তবে মাকসুদা বেগমের বিশ্বাস কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বোঝানো যায় নারীদের শিক্ষা কতটা জরুরি। শহরে নারীকেন্দ্রিক সভা-সমাবেশ হলেও তা শহরকে ভেবেই করা হয়। কিন্তু প্রান্তিক অঞ্চলের কথা ভাবা হয় না।

দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের বিষয়ে মাকসুদা বেগম আশাবাদী। দেশ এখন ডিজিটাল হচ্ছে। তবে সমস্যাও আছে। নারীর প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কারিগরি দক্ষতা ও আর্থিক সহযোগিতা দরকার। শুধু প্রযুক্তি পেলেই হবে না। সহায়ক যন্ত্রটাও পেতে হবে। আর যন্ত্রটি তো ব্যয়বহুল। আবার যন্ত্র পেলেও সেটি ব্যবহার দক্ষতা বোঝাতে হবে। এসব বিষয়গুলো বুঝে যখন নীতিনির্ধারণ করা হবে তখন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবেই। 

ইত্তেফাক/পিও/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন