বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গল্প

সারপ্রাইজ

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৩, ১১:৫৮

বারবার অ্যালার্মটা বেজেই যাচ্ছে। আজ তো ছুটির দিন। কেউ কোথাও নেই নাকি? ইস! উঠতে ইচ্ছা করছে না। চোখ বন্ধ করেই তারান্নুম বিছানায় নীলাভকে খুঁজল। না, ও তো নেই। কোথায় গেল এত সকালে! একটু দূরে টেবিলের ওপর ঘড়িটা রাখা। হাত বাড়াতেই একটি কাগজ হাতে লাগল, ঘড়িটায় জাস্ট আটটা বাজে। বেশ বেলাও তো হয়েছে। কাগজটা বাড়িয়ে নিতেই নীলাভের হাতের লেখা, বড় বড় অক্ষরে—‘হ্যাপি অ্যানিভার্সারি! গুড মর্নিং, তারান! ডাইনিংয়ে কফি, প্লিজ টেক ইট।’

—আস্ত একটা পাগল! বলতে বলতে তারান বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখে তার চটিজোড়া ঠিক বিছানার সামনে রাখা, চটিতে পা গলিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার ডাইনিং ঘর পর্যন্ত! গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো তার পায়ের চলার এই পথটিতে। খুশিতে ছুটে গেল তারান, ওর ভোরের কফিটায় চুমুক দিতে! প্রথম চুমুকেই মনে হলো, ইস চিনি দেওয়া হয়নি, কাপের নিচের পিরিচটায় চিনির প্যাকেট খুলতেই বেরিয়ে পড়ল ছোট্ট একটি চিরকুট—‘বইয়ের আলমারির কাছে যাও, তোমার প্রিয় বই হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ বইটি খোলো।’

তারান হাসতে হাসতে দৌড়ে গেল, দেবী খুলতেই আরেকটি চিরকুট—‘একটু রান্নাঘরে যাবে? ময়দার বয়ামটা দেখবে?’...যে কথা সেই কাজ, ময়দার বয়াম খুলে হাত ঢুকিয়ে পেয়ে গেল আলমারির চাবি! এখানে আলমারির চাবি! বিস্মিত তারান আলমারি খুলতেই হ্যাঙারে ঝোলানো লাল রঙের একটি ড্রেস ঝুলতে দেখল, ড্রেসের গায়ে পিন করে কাগজে লেখা—‘তোমাকে খুব সুন্দর দেখাবে, ড্রেসটি পরে উত্তর দিকে জানালায় তাকাও।’

চটজলদি সে রেডি হয়ে জানালায় তাকিয়ে দেখল একটি হলুদ রঙের ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে। ট্যাক্সির গায়ে সেঁটে লেখা—‘নিচে নেমে এসো, প্লিজ।’

লক্ষ্মী মেয়ের মতো ১১ তলার ছোট্ট ছিমছাম ফ্লাট থেকে নেমে এলো লাল পরীটি। নামতেই ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যাক্সির দরজা খুলে দিল। উঠে পড়তেই ট্যাক্সিটা চলতে লাগল উত্তরার দিকে। এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে, এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে এসে থামল ট্যাক্সি ড্রাইভার। কোনো কথা না বলেই একটি চিরকুট তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিটি বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেতেই হাতে দেখল—কম্পার্টমেন্ট নম্বর, সিট নম্বর ও ট্রেনের সময়, লেখা একটি টিকিট। আর মাত্র পাঁচ মিনিট। দৌড়ে উঠে গেল, ঘোরের মধ্যে।

—এরপর কী? কোথায় নীলাভ? নিশ্চয়ই আরো সারপ্রাইজ দেবার জন্য কোথাও লুকিয়ে আছে, ভাবতে ভাবতেই কম্পার্টমেন্ট আর সিট নম্বর খুঁজে বসতে গিয়ে দেখে একটি ছোট্ট সুন্দর লাগেজ রাখা, লাগেজের হাতলে আবারো ছোট্ট একটি চিরকুট—‘তিনটি স্টেশন পরে জানালা দিয়ে বাইরে, ডানদিকে তাকাবে।’

তারান হাসছে ভেতরে ভেতরে। এতদিন পর নীলাভ তেমনটি হয়ে উঠল, আমি যেমনটি চাই।

সারপ্রাইজ! এক্সাইটমেন্ট। উফ! ভাবতে পারছি না! এমন একটি সারপ্রাইজের অপেক্ষা করেছি সবসময়। কেবলই ওর বোরিংনেস আমাকে কষ্ট দিয়েছে। কুল! চার্মহীন একটি মানুষ মনে হয়েছে সবসময়। বিয়ের ছ’মাস যেতেই টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। বিয়ের আগের চার বছর দেখার পরও ও কি বোঝে নাই—আমি অতটা ঘরকুনো নই? প্রাইভেট ব্যাংকের চাকরি ওর, তবুও তো ওর আমাকে প্রোপার সময় দেওয়া উচিত ছিল। আসলে কী, আমিও তো বুঝিনি ওকে। সারা দিনের বোরিং সময়টুকু আমিও কি চাপিয়ে দেইনি ওর ওপর?

আজ এক বছর পূর্ণ হলো। আহা! আমি তো সব ভুলেই গেছিলাম, রাগে, দুঃখে, অভিমানে। নীলাভ সব মনে রেখেছে। আর আমার জন্য কত চমত্কার সব সারপ্রাইজ রেখে দিয়েছে।

—আর মাত্র দুটি স্টেশন পরেই তোমাকে দেখব নীলাভ। আমি তোমাকে সরি বলে জড়িয়ে ধরে সবার মধ্যে চিত্কার করে ‘ভালোবাসি’ বলব। ভাবতে ভাবতে তারান টের পেল ওর গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি হাতের চেটোয় মুছে হাসতে লাগল। বাইরে কাশফুলগুলো দৌড়ের প্রতিযোগিতা করছে ট্রেনটির সঙ্গে।

—আচ্ছা নীলাভ কোথায় যেতে চায়, ট্রিপে, এটা তো রাজশাহীর ট্রেন। ও পথ থেকে উঠবে? সামনে ঈদ। তবে কি বাড়িতে এবার সবাই মিলে ঈদ করব, আমরা? মা-বাবাও ভীষণ সারপ্রাইজ হবে।

নীলটা বরাবরই একটু খ্যাপাটে। আমি বারবার ওকে ভুল বুঝে দূরে সরে গেছি। না নীল আর না। আমি আর তোমায় ভুল বুঝব না। তুমি থাকো আমি আসছি।

সকাল থেকে পাওয়া চিরকুটগুলো হ্যান্ড ব্যাগ থেকে বের করে হাসছে, আর দেখছে তারান। বিস্ময়ে, ভালোলাগায় লাল হয়ে উঠছে হালকা মেকাপ করা গালদুটি।

—মাঝে মাঝে জীবন এত পরিপূর্ণ লাগে। এত সুন্দর হয়ে ওঠে চারপাশ। ছটফট লাগছে। আর একটি স্টেশন। কখন নীলাভের সঙ্গে দেখা হবে? ঝকঝক শব্দ তুলে ট্রেনটি দুলে দুলে যাচ্ছে তারানের সমস্ত ভালোবাসাকে এক করে। মনে পড়ে যাচ্ছে ওর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের মূহূর্তগুলি। কী লাজুক ছিল নীলাভ! একসঙ্গে এমবিএ করা, নিঃসঙ্গ জীবনে পাশে এসে দাঁড়ানো নীলটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি—ভাবতে ভাবতে হঠাত্ ট্রেনটি থেমে গেল তৃতীয় স্টেশনে।

হ্যাঁ তাই তো তৃতীয় স্টেশন! দুরু দুরু বুকে তারান ডানে তাকাল, কোথায় নীলাভ? ইতিউতি করে এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতেই চোখে পড়ল প্লাটফরমের মাঝখানের দিকে একটি নেমকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নীলাভ, হ্যাঁ নীলই তো! নেমকার্ডে বড় বড় করে কী লেখা ওটা? ভুল দেখছে কি তারান! বড় বড় করে অক্ষরে লেখা ‘গুডবাই তারান!’

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন