সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

গল্প | তমিস্রা

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৫

উঁচু রাস্তার নিচে দুই পাশের ঢালু জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে একদল মানুষ। নানা স্থান থেকে, নানা সময়ে এই মানুষগুলো এই দঙ্গলে জড়ো হয়েছিল। ‘এই হিম হিম হাওয়া পরশা’র কৃষ্ণপক্ষের আলো-আঁধারিতে ছাওয়া জায়গাটিতে কেউ বলতে পারবে না—এরা কোথায় যাচ্ছিল। তবে এদের গন্তব্য যদি একটি স্টেশন আগেও হতো, তাহলে এরা এই অবস্থায় পড়ে থাকত না।

নতুন ধান আর খড়ের গন্ধে চারদিকের বাতাস আমোদিত। নগরায়ণের আগ্রাসনের পরও এরকম প্রায় পরিত্যক্ত স্থান রয়েছে দেশের কোনো কোনো স্থানে। তাই, কোনো অপরাধ ঘটার কিছুক্ষণ পরও আলামতগুলি অবিকৃত থাকে। আশপাশের সবচেয়ে কাছের গ্রামটিও আধমাইল দূরে। কেবল একটি বিকট ধাতব শব্দই তাদের কারো কারো কানে পৌঁছেছিল, তাই কেউ এখনো এখানে এসে পৌঁছেনি। যে মধ্যবয়স্ক মানুষটি উপুড় হয়ে পড়ে ছিল, তার পরনে এই শীতেও একখানি সাদা ধুতি। ওপরে সোয়েটার। মানুষটার নাম কী? হয়তো খগেন বা দয়ারাম। না, দয়ারাম নামটায় ঠিক বাঙালিয়ানার গন্ধ নেই। হয়তো তার নাম সুরেন্দ্রনাথ বা সুনীল কর্মকার। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটি পুরোনো, তবে দামি। ওতে নানা জিনিসের সঙ্গে একটি সোনার আংটি আছে। আংটিটির ঘের একেবারে ছোট। কে জানে হয়তো এই প্রৌঢ় তার কোনো নাতনিকে দেখতে যাচ্ছিলেন। খেতের ধান কেটে নেওয়ার পর যেরকম ধানের গোড়া রয়ে যায়, তেমনি শক্ত কিছু গুল্ম। তার ওপর দুই জন পুরুষ মানুষ পড়ে আছে। তাদের পরনে মলিন লুঙ্গি, আর পুরোনো সোয়েটার। পায়ে সস্তা রবারের চপ্পল। গায়ে বালি আর মাটির গুঁড়ো লেগে আছে। বয়স ত্রিশের নিচে হবে। এদের সঙ্গে কোদাল ছিল। সেগুলো কোথায় যেন ছিটকে গেছে। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে এদের এই বিপত্তি। সুরুজ আলী নামের লোকটার সঙ্গে একটা টিফিন ক্যারিয়ার ছিল। ওতে ছিল দুপুরের খাবারের অবশিষ্ট।

ডোবায় পড়ে রয়েছে একটা শিশুর লাশ। শিশুটির জিন্সের হাফ-প্যান্টটি দামি। জাম্প কেড্সটি নতুন। ফর্সা ও স্বাস্থ্যভরা মুখ দেখে বোঝা যায়, ভালো খেয়েদেয়ে শিশুটি বড় হচ্ছিল। সঙ্গে ছিল মামা, সে বাসের ভেতর এখনো আটকে আছে।

রাস্তার ও খেতের মাঝখানের ঢালে চারটি মানুষ শুয়ে আছে। এরা নারী। এদের পায়ে সস্তা রবারের স্যান্ডেল, পরনে সুতি শাড়ি এবং গায়ে পুরোনো গরম চাদর। প্রত্যেকের ঘাড় ভাঙা। নাক দিয়ে রক্তের দুটো স্রোত বুকের কাছে এসে শুকিয়ে রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে এরাও শ্রমজীবী। শকটটির ভেতরে কালো বোরকা, ভেতরে সেলোয়ার এবং পায়ে মাঝারি মানের একজোড়া হাইহিল জুতো পরিহিতা এক নারীকে দেখা যাচ্ছিল। মেয়েটির বয়স বাইশ-তেইশ হবে। একটু আগেও গোঙাচ্ছিল। কই মাছের প্রাণ তো। নইলে কি অত যন্ত্রণা সহ্য করে এই বসুমতীকে এত শিশুর কলকাকলিতে এরা ভরে দিতে পারত? একটু আগে উদ্ধার করে কোনো হসপিটালে নিতে পারলে মেয়েটি হয়তো-বা বেঁচে যেতে পারত।

বোরকাওয়ালি এত রাতে কোথায় যাচ্ছিল? এ-ও একজন শ্রমজীবী। ইট বা মাটি টানা না হলেও কাজটি হলো ঠিকানাবিহীন একটি ওষুধ কোম্পানির লিফলেট বিনা মূল্যে মানুষকে দেওয়া। এসব লিফলেটে জটিল, কঠিন ও পুরোনো রোগের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে মানবকুলের হেন ব্যাধি নেই, যার নিরাময়ের ওষুধের কথা বলা হয় না। ল্যামিনটেড আইডি কার্ডয়ের আদলে কিংবা নিউজপ্রিন্টের ওপর ছাপানো এই প্রচারপত্রটিতে শক্তি ও সৌর্যবীর্যের চিহ্ন হিসেবে অনেক সময় কুমির বা লম্ফমান ঘোড়ার ছবিও শোভা পায়। ছাইদানের ছাই, আমলকী, বহেরা, ভুজপাতা, বাইন্যা আদা ও অন্যান্য মহাভেষজ থেকে শুরু করে সর্বশেষ অ্যালোপ্যাথিকে নাকচ করে দিয়ে এই প্রচারপত্রে দাবি করা হয়—এগুলো রোগ নিরাময়ে অব্যর্থ। এই মেয়েটির কাজ ছিল সব ধরনের যানবাহনের দরজা-জানালা এবং অন্য যে কোনো ছিদ্রপথে এই প্রচারপত্রটি যত বেশি সম্ভব, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ রোগীর হাতে পৌঁছে দেওয়া, তথা নিক্ষেপ করা। আজও মেয়েটি পাঁচ শ প্রচারপত্র যথাস্থানে নিক্ষেপ করে ‘প্রচারেই প্রসার’—দর্শন বাস্তবায়নের কাজে ভূমিকা রেখে দিনশেষে বাড়ি ফিরছিল।

মেয়েটির সামনে একটা তরল পদার্থ শকটের মেঝেকে আঠাল করে রেখেছে। পাশেই একটা বালতি উলটে আছে। যে প্রৌঢ় মানুষটি এই তরল পদার্থের মালিক, তার নাম হারাধন। এই দুধটুকু আজ বিক্রি করতে পারেনি। তবে সত্তর টাকা মূল্যের এই দ্রব্যটুকু ফেরত নিয়ে বাড়ি আসার পথে তার অমূল্য প্রাণটুকু খোয়া গেছে। হারাধনের নাক ও দাঁত থেঁতলে সামনের সিটের পেছনের অংশের সঙ্গে লেগে আছে।

এর পাশের সিটে একটি মধ্যবিত্ত দম্পতি মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে। যানবাহনে শ্রেণি রক্ষা করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পাশে সিট পড়তে পারে দুধ বা তেলওয়ালার কিংবা র্যাব খুঁজছে এমন সমাজসেবীর। তেমনি এ দম্পতিটিও পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট। দম্পতি সরকারি কাজে ভ্রমণ করছিলেন।

এ খোলা জায়গায় মানুষগুলো কীভাবে এলো? শকটের দরজা মাত্র একটি—এত মানুষ তো আর ওদিয়ে ছিটকে বের হয়ে আসতে পারে না। যারা অক্ষত ছিল, তারাই এদেরকে বাইরে এনেছে। চিকিত্সার জন্য কোথাও পাঠানো যায় কি না, দেখার জন্য। আর দূরে ছিটকে পড়া মানুষগুলো ছাদে চড়ে যাচ্ছিল। তারা দুটি বিপরীত মুখী যানের সংঘর্ষ হওয়া মাত্র দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। মাধ্যাকর্ষণের আর্কষণ আগ্রাহ্য করতে পারেনি।

‘যদি হয় সুজন, পাতায় বসে নয় জন’—এরা সুজন ছিল, তাই পাঁচ টন ট্রাকে যেমন চোদ্দো টন ওজন অনায়াসে চলে যায় গন্তব্যে, এখানেও বহনক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী চড়ে যাচ্ছিল। এভাবে অনেক দিন চললেও আগে কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। তবে আজ এ বাহনের একটু কায়ক্লেশ হয়ে গেল। তিন জনের সিট; তাতে চার জন এসেছে।

পেছনের একটি স্থান থেকে এক বৃদ্ধাকে টেনে বের করা হলো বড় কষ্টে। কারণ জানালার মাপ যা হবার কথা, তার চেয়ে চার ভাগের এক ভাগ করে কম। তিনিও মারা গেছেন। তার হাতের মুঠোয় ধরা এক জোড়া বড় নারিকেল। বাসের মেঝেতে বাড়ি খেয়ে একটি ফেটে গিয়ে পানি বের হয়ে জায়গাটি ভিজে রয়েছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মী এবং অ্যাম্বুলেন্স আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। গ্রামবাসীরাও আসা শুরু করেছে। আহত ও নিহতদের উপজেলা হাসপাতালে পাঠানো হলো। যে স্থানটিতে ভুল বানানে লেখা থাকে, ‘অভিযোগ থাকলে চালককে বলুন’—সেখানে বা অন্যকোনো স্থানে চালক বা হেল্পারকে পাওয়া গেল না। কিন্তু তারা গলবস্ত্রে পালিয়েছেন, তার প্রমাণ নেই। তাই তদন্তকারী তাদেরকে পলাতক হিসেবেও তালিকাভুক্ত করতে পারলেন না। সুস্থ এবং স্যুট ও টাই পরা একজন যাত্রীকে তদন্তকারী জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। তিনি যন্ত্রদানব দুটির সুরতহাল রিপোর্টও তৈরি করলেন। তা নিম্নরূপ—

হতাহতের সংখ্যা: দুই জন, সাত জন আহত, ১৩ জন নিহত। হতাহতের কারণ: ব্রেক ফেল। মন্তব্য: দুর্ঘটনা।

যারা নিহত হয়েছিল, তাদের ঘড়ি, আংটি এবং মানিব্যাগ কে বা কারা যেন এর আগেই নিয়ে গেছে। জনতা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এ রাস্তায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে গেল। দারোগা থানায় ফিরে এ ঘটনাটিকে সড়ক দুর্ঘটনার শ্রেণিতে একটি জিআর মামলা হিসেবে তার খাতার মধ্যে লিপিবদ্ধ করলেন। রাত গভীর হতে থাকল। একফালি ভাঙা চাঁদ আকাশে দেখা দিল। ঘটনাস্থলে কোনো সাংবাদিক আসতে পারেনি। খবর পেয়ে তারা থানায় এসে নানা তথ্য লিপিবদ্ধ করতে থাকলেন।

সে রাতে লিপিবদ্ধ যা হলো না, তা হলো এই যে—দুটি যানবাহনের ধারণক্ষমতা ৭০ জন হলেও ১২০ জন যাত্রী ওতে চড়েছিল। ছাদেও মোট পঁচিশ জন যাত্রী ছিল। যান দুটির একটি করে হেডলাইট, সমস্ত সিগন্যাল লাইট এবং ব্রেক লাইটের স্থানগুলোতে শুধু ফাঁকফোকর ছিল, কোনো বাতি ছিল না। গত চার বছরে এ যান দুটি একবারও ফিটনেস পরীক্ষায় হাজির হয়নি। বাস চালাচ্ছিল দুই জন হেলপার, তাদের লাইসেন্স দুটি স্বরচিত। যে রাস্তা দিয়ে এরা পার হচ্ছিল, তা চোদ্দো ফুট চওড়া। রাস্তার দুই পাশেই নরম মাটি। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা ফিটনেসের নথিতে যান দুটির লাইট ব্রেক, সিটের মাপ, সিট-সংখ্যা, চালকের লাইসেন্স ইত্যাদি পরীক্ষা করে সবকিছু সঠিক দেখতে পেলেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নথিতে রাস্তাটিকেও বিশ ফুট চওড়া হিসেবে তৈরি হয়েছে—তা রেকর্ডভুক্ত বলে দেখতে পেলেন।

তদন্তকারী দেখলেন বাস দুটোর রং বলে কিছুই নেই। নিরাভরণ, নিরাবরণ টিন এবং তাতে নানা সংঘর্ষের ক্ষতচিহ্ন। গিয়ার বক্সটি একটি দড়ি দিয়ে বাঁধা। ইঞ্জিন কভারের ওপর একটি ময়লা কাঁথা শোভা পাচ্ছে। জানালার অনেকখানেই কাচের বদলে নীল-সাদা মোটা পলিথিন, স্কচটেপ দিয়ে লাগানো। টায়ারে ‘গেটিস্’ লাগানোর ফলে ওগুলো লাফিয়ে-লাফিয়ে ঘুরত। চাকার এক্সেলের সঙ্গে লাগানো আটটি করে নাটের স্থান আছে কিন্তু তিন-চারটি করে নাট নেই। শুধু বল্টু বের হয়ে আছে।

যে আইনে বলা আছে, এ ধরনের শকটের রাস্তায় চলতে হলে এর কোথায় কী থাকতে হবে—সে আইনটি দেড় শ বছরের বেশি পুরোনো। তদন্তকারী বিরক্ত হয়ে ভাবলেন—এ বিষয়ে গণমুখী এবং স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আইন বানানো প্রয়োজন।

এসব চিন্তা করতে করতে তিনি আজ সকালে পাওয়া একটি বিশেষ কাগজের বান্ডিল আবার দেখ তার প্রতিবেদনে লিখলেন—সাক্ষ্য, প্রমাণ, তথ্য ও আলামত বিচার বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, এটি একান্তই একটি দুর্ঘটনা।

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন